মশার পছন্দের রক্ত: বিজ্ঞান যা বলছে।

বিজ্ঞান ডেস্ক
আপনার রক্তের গ্রুপ কি আপনাকে মশার সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে? যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই ধারণাটি কি শুধুই মিথ, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য? বিস্তারিত জেনে নিন এই প্রতিবেদনে।
গরমের সন্ধ্যা হোক বা বর্ষার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, মশার উপদ্রব প্রায় সবখানেই। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন, একই জায়গায় বসে থাকা সত্ত্বেও আপনার বন্ধুটির চেয়ে আপনাকেই মশা কেন বেশি কামড়ায়? অনেকেই মজা করে বলেন, “তোমার রক্ত হয়তো বেশি মিষ্টি!” যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, নির্দিষ্ট রক্তের গ্রুপের মানুষকে মশা বেশি পছন্দ করে, বিশেষ করে যাদের রক্তের গ্রুপ ‘O’। কিন্তু এই ধারণাটি কি শুধুই একটি প্রচলিত মিথ, নাকি এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে? চলুন, এই রহস্যের গভীরে যাওয়া যাক।
মিথ নয়, কিছুটা হলেও সত্য
অবাক করার মতো বিষয় হলো, মশার রক্ত পছন্দের বিষয়টি পুরোপুরি মিথ নয়। একাধিক গবেষণা এই ধারণার পেছনে আংশিক সত্যতা খুঁজে পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে, মশা tatsächlich কিছু মানুষকে অন্যদের চেয়ে বেশি পছন্দ করে এবং এর পেছনে রক্তের গ্রুপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গবেষণা কী বলছে?
এই বিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণাগুলোর মধ্যে একটি জাপানে পরিচালিত হয়েছিল। গবেষণায় দেখা যায়, স্ত্রী মশা (যারা মূলত রক্ত পান করে) ‘O’ গ্রুপের রক্তের মানুষের উপর বসার জন্য প্রায় দ্বিগুণ আগ্রহী, তুলনামূলকভাবে ‘A’ গ্রুপের মানুষের চেয়ে। ‘B’ গ্রুপের মানুষের প্রতি তাদের আকর্ষণ ছিল মাঝারি মানের।
অর্থাৎ, গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী क्रमটি হলো:
- O গ্রুপ (সবচেয়ে বেশি পছন্দের)
- B গ্রুপ (মাঝারি পছন্দের)
- A গ্রুপ (সবচেয়ে কম পছন্দের)
বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা: কেন O গ্রুপ এগিয়ে?
এখন প্রশ্ন হলো, মশা কীভাবে রক্তের গ্রুপ বোঝে এবং কেনই বা ‘O’ গ্রুপের প্রতি তাদের এত আকর্ষণ? এর পেছনে মূল কারণ হলো ‘সিক্রেটোর’ স্ট্যাটাস (Secretor Status)।
আমাদের মধ্যে প্রায় ৮৫% মানুষই ‘সিক্রেটোর’। এর অর্থ হলো, তারা তাদের রক্তের গ্রুপের অ্যান্টিজেন ত্বকের মাধ্যমে ঘাম বা অন্যান্য শারীরিক রসের সঙ্গে নিঃসৃত করে। মশা এই রাসায়নিক সংকেত অনুভব করতে পারে এবং এর মাধ্যমে তারা দূর থেকেই রক্তের গ্রুপ শনাক্ত করতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মশা ‘O’ গ্রুপের অ্যান্টিজেনের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। তাই আপনি যদি ‘O’ গ্রুপের অধিকারী হন এবং একজন ‘সিক্রেটোর’ হন, তাহলে মশার কাছে আপনি একজন আকর্ষণীয় লক্ষ্যবস্তু।
শুধু রক্তই নয়, মশা আকর্ষণের আরও কিছু কারণ
তবে শুধু রক্তের গ্রুপই মশা আকর্ষণের একমাত্র কারণ নয়। আরও বেশ কিছু বিষয় এর সঙ্গে জড়িত, যা আপনাকে মশার ‘হিট লিস্ট’-এ ফেলে দিতে পারে।
- কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO₂): আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে যে কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করি, তা মশার জন্য একটি বড় আকর্ষণ। যারা শারীরিকভাবে বড় বা যাদের বিপাকক্রিয়ার হার বেশি (যেমন: গর্ভবতী নারী বা ব্যায়াম করার পর), তারা বেশি CO₂ নির্গত করেন এবং মশাকে বেশি আকর্ষণ করেন।
- শরীরের তাপমাত্রা ও ঘাম: মশা উষ্ণ দেহ পছন্দ করে। আমাদের ঘামের সঙ্গে নিঃসৃত ল্যাকটিক অ্যাসিড, ইউরিক অ্যাসিড এবং অ্যামোনিয়ার মতো রাসায়নিক পদার্থ মশাকে চুম্বকের মতো টানে।
- ত্বকের জীবাণু: আমাদের ত্বকে বসবাসকারী নির্দিষ্ট ধরনের জীবাণু কিছু স্বতন্ত্র গন্ধ তৈরি করে, যা মশাকে আকর্ষণ করতে পারে। একারণেই ব্যক্তিভেদে মশার কামড়ানোর হার ভিন্ন হয়।
- পোশাকের রঙ: মশা গাঢ় রঙের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। কালো, গাঢ় নীল বা লাল রঙের পোশাক পরলে মশার নজরে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- বিয়ার পান: একটি ছোট গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিয়ার পান করার পর শরীর থেকে নিঃসৃত ইথানল এবং শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মশা বেশি আকৃষ্ট হতে পারে।
তাহলে বাঁচার উপায় কী?
রক্তের গ্রুপ বা জেনেটিক্স পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করে মশার কামড় থেকে অনেকটাই বাঁচা যায়।
- রিপেলেন্ট ব্যবহার: DEET বা পিকারিডিনযুক্ত মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করুন।
- হালকা রঙের পোশাক: বাইরে যাওয়ার সময় হালকা রঙের এবং শরীর ঢাকা পোশাক পরুন।
- সঠিক সময় নির্বাচন: মশা সাধারণত ভোরবেলা এবং সন্ধ্যার সময় বেশি সক্রিয় থাকে। এই সময়ে বাইরে কম বের হওয়ার চেষ্টা করুন।
- পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা: বাড়ির আশেপাশে পানি জমতে দেবেন না, কারণ জমা পানি মশার প্রজনন ক্ষেত্র।
শেষ কথা:
সুতরাং, এটা বলা যেতেই পারে যে ‘O’ গ্রুপের রক্ত মশাকে বেশি আকর্ষণ করে—এই ধারণাটি মিথ্যে নয়, বরং এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে। তবে এটিই একমাত্র কারণ নয়। আপনার বিপাকক্রিয়ার হার, শরীরের গন্ধ, পোশাকের রঙ এবং নিঃশ্বাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড—এই সবকিছু মিলেই নির্ধারিত হয় আপনি মশার কাছে কতটা আকর্ষণীয়। তাই পরের বার যখন দেখবেন আপনাকে মশা একটু বেশিই জ্বালাতন করছে, তখন শুধু নিজের রক্তের গ্রুপকে দোষ না দিয়ে অন্যান্য বিষয়গুলোর দিকেও নজর দিতে পারেন।



