অপরাধদুর্নীতি

কনস্টেবলের আলাদিনের চেরাগ: নিয়োগ বাণিজ্যে ঢাকায় ফ্ল্যাট, এলাকায় রাজপ্রাসাদ!

অপরাধ বিচিত্রা অনলাইন ডেস্ক

একসময় জীবিকার তাগিদে খাল-বিল থেকে শাপলা তুলে বিক্রি করতেন। অভাবের সঙ্গে লড়াই করে পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র ১৫-১৬ বছরের ব্যবধানে সেই পুলিশ কনস্টেবল জেএম খালেক এখন অঢেল সম্পদের মালিক। রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা বসুন্ধরা ও মিরপুরে একাধিক ফ্ল্যাট, নিজ এলাকা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় কোটি টাকা মূল্যের দৃষ্টিনন্দন বাড়িসহ প্রায় অর্ধশত বিঘা জমির মালিক তিনি। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশে চাকরি এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য ও তদবিরের মাধ্যমেই তিনি এই বিপুল সম্পদ গড়েছেন।

যেভাবে উত্থান

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মঠবাড়িয়ার শাখারীকাঠি গ্রামের এস্কান্দার জমাদ্দারের ছেলে জেএম খালেক ২০০৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। বরিশাল ও ঝালকাঠিতে কিছুদিন কাজ করার পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) বদলি হন। রাজারবাগে কর্মরত অবস্থায় এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার আত্মীয়ের সঙ্গে সখ্যতাকে পুঁজি করে তিনি নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগ অনুযায়ী, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মীসহ বিভিন্ন সরকারি পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে শুরু করেন তিনি।

সম্পদের পাহাড়

অকল্পনীয় দ্রুততায় বাড়তে থাকে খালেকের সম্পদ। তার উল্লেখযোগ্য কিছু সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে:

  • বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়: দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, যেখানে তিনি বর্তমানে সপরিবারে বসবাস করেন।
  • মিরপুরের নতুন বাজার: বেকারি গলিতে একটি ভবনের তৃতীয় ও পঞ্চম তলায় দুটি আধুনিক ফ্ল্যাট।
  • মঠবাড়িয়া পৌরসভা: ২০২০ সালে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি চারতলা রাজকীয় বাড়ি এবং এর পেছনেই নির্মাণাধীন আরেকটি তিনতলা ভবন।
  • বরিশাল: নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাড়ি করার জন্য কেনা প্লট।
  • গ্রামের বাড়ি ও আত্মীয়দের নামে: নিজ গ্রাম, শ্বশুরবাড়ি ও বোনের বাড়ির আশপাশে প্রায় অর্ধশতাধিক বিঘা ধানি জমি।

অভিযোগ রয়েছে, চাকরি ছাড়লেও তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ প্রায় ২০টি মন্ত্রণালয়ে এখনও তদবির বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রভাব বিস্তারে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও অর্থপাচার

জেএম খালেক এলাকায় রাজনৈতিকভাবেও প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। মঠবাড়িয়া আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশের অর্থদাতা হিসেবে তিনি পরিচিত। ২০২৪ সালের জাতীয় ও উপজেলা নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীদের জেতাতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করার জনশ্রুতি রয়েছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ভারতে আত্মগোপন করলে খালেক সেখানে গিয়ে তাঁদের আর্থিক সহায়তা দেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

প্রশাসনের চোখ এড়াতে তিনি অন্যের নামে কেনা কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১২৩০৩৭) ব্যবহার করেন। এর আগে তার গাড়িতে সংসদ সদস্যের স্টিকারও ব্যবহার করা হতো। যোগাযোগে চালাকির আশ্রয় নিয়ে তিনি বিদেশি রাউটার ও শতাধিক বেনামি সিম কার্ড ব্যবহার করেন বলে জানা গেছে।

তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ

খালেকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এর আগেও অভিযোগ উঠেছিল। তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের কাছে অভিযোগ করা হলে তিনি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তা ধামাচাপা দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একই অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করা হলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সংস্থাটি তদন্তে অগ্রসর হয়নি। দুর্নীতির মামলা থেকে বাঁচতেই তিনি করোনার সময় চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।

কিছুদিন আগে যৌথ বাহিনী তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালালেও আগাম খবর পেয়ে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ও তদন্তের দাবি

জেএম খালেকের এই অবিশ্বাস্য উত্থান ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বাচ্চু মিয়া আকন বলেন, “একজন কনস্টেবলের এত সম্পদ! দুদকের উচিত বিষয়টি দ্রুত অনুসন্ধান করা।”

উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মাহবুবুল ইসলাম ও জামায়াত নেতা তারেক মনোয়ারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও অবিলম্বে তাকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, খালেক যত ধূর্তই হোন না কেন, তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তবে অভিযোগ উঠেছে, অবৈধ সম্পদ বাঁচাতে তিনি এখনও কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রয়েছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button