সাংবাদিককে লকাবে আটকে ওসি বাবুল আজাদের দাপট: বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে সেই পুরোনো নাম

চট্টগ্রামে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে থানার ওসির হাতে সাংবাদিক হেনস্তা ও ২০ মিনিট হাজতবাসের শিকার। বাবুল আজাদের বিরুদ্ধে অতীতেও ছিল ক্ষমতা অপব্যবহার ও দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ।
ডেস্ক রিপোর্ট
চট্টগ্রামে আবারও বিতর্কের জন্ম দিলেন ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল আজাদ। এবার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে একজন সাংবাদিককে প্রকাশ্যেই ডিসি পদমর্যাদার কর্মকর্তার সামনে হেনস্তা, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত এবং থানার হাজতে প্রায় ২০ মিনিট আটকে রাখার। এই ঘটনায় চট্টগ্রামের সাংবাদিক মহলে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে। একইসাথে, ওসি বাবুল আজাদের বিতর্কিত অতীত কর্মকাণ্ড নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
ডবলমুরিং থানায় আসলে কী ঘটেছিল?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অভিযোগ এবং সাংবাদিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরোর নিজস্ব প্রতিবেদক সাংবাদিক মোহাম্মদ মাসুম পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য ডবলমুরিং থানায় যান। সেখানে কোনো একটি বিষয় নিয়ে ওসি বাবুল আজাদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। অভিযোগ উঠেছে, এক পর্যায়ে ওসি বাবুল আজাদ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) একজন উপকমিশনারের (ডিসি) সামনেই সাংবাদিক মাসুমের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। এরপর তাঁকে থানার হাজতে (লকআপ) প্রায় ২০ মিনিটের জন্য আটকে রাখা হয়।
ভুক্তভোগী সাংবাদিকের সহকর্মীরা এই ঘটনাকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। একজন সাংবাদিক লিখেছেন, “ভালবাসার লাল স্বাধীনতার নামে সাংবাদিকতার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একের পর এক সাংবাদিক হত্যা, হামলা, মামলা ও জুলুম-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, এটাই কি স্বাধীন সাংবাদিকতা?”
এই ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যে ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়, তার একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে।
কে এই বাবুল আজাদ? বিতর্কের দীর্ঘ ইতিহাস
বাবুল আজাদ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন আলোচিত ও সমালোচিত কর্মকর্তা। তাঁর কর্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতা অপব্যবহার, দুর্নীতি এবং সাধারণ মানুষকে হয়রানির মতো একাধিক গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ঘেঁটে তাঁর সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্য পাওয়া যায়:
১. সীতাকুণ্ডে থাকাকালীন বিতর্ক: ডবলমুরিং থানায় যোগদানের আগে বাবুল আজাদ সীতাকুণ্ড থানার ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেই সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন শিল্প গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা, অবৈধ দখলদারদের সহায়তা এবং দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড এবং কারখানার মালিকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ ছিল।
২. জমি দখলে সহায়তার অভিযোগ: তাঁর বিরুদ্ধে একাধিকবার নিরীহ মানুষের জমি দখলে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহায়তার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারীরা দাবি করেছেন, ওসি বাবুল আজাদ প্রতিপক্ষের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদের হয়রানি করেছেন।
৩. নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো: বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের মতো গুরুতর অভিযোগও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
৪. রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ: বাবুল আজাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের ব্যবহার করে নিজের প্রভাব ধরে রাখার অভিযোগও পুরোনো। তাঁর কার্যকলাপে অনেক সময় পেশাদারিত্বের চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যের ছাপ স্পষ্ট ছিল বলে মনে করেন অনেকে।
৫. পূর্বেও সাংবাদিক হেনস্তার অভিযোগ: অতীতেও তাঁর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সমালোচনামূলক সংবাদ যাঁরা করেছেন, তাঁদের তিনি বিভিন্নভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করেছেন বলে জানা যায়।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পুলিশের ভূমিকা
সাংবাদিক নেতারা বলছেন, ডবলমুরিং থানার এই ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নয়। এটি পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের বহিঃপ্রকাশ। যখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা আইনের রক্ষক হয়ে নিজেই আইন ভঙ্গ করেন এবং একজন সাংবাদিককে তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেন, তখন তা পুরো ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি করে।
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে) এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং অবিলম্বে ওসি বাবুল আজাদকে প্রত্যাহারসহ তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে। তাদের মতে, যদি এই ধরনের ঘটনার বিচার না হয়, তবে ভবিষ্যতে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও নির্যাতন আরও বাড়বে, যা একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত।
এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় পর্যন্ত সিএমপির পক্ষ থেকে ওসি বাবুল আজাদের বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। তবে ঘটনাটি নিয়ে পুলিশ প্রশাসনেও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। সামগ্রিকভাবে, এই ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করল যে, মাঠ পর্যায়ে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করা কতটা জরুরি।



