সীমান্তের ডন মঈন চেয়ারম্যান: চোরাচালান, মাদক থেকে খুন—অভিযোগের পাহাড়, প্রশাসন কি নীরব?

চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের সাবেক চেয়ারম্যান মঈন উদ্দিনের বিরুদ্ধে স্বর্ণ পাচার, মাদক বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির ভয়ংকর সাম্রাজ্য গড়ে তোলার অভিযোগ। একাধিক মামলা থাকলেও তিনি থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অনুসন্ধানী ডেস্ক
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর—জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ভারত সীমান্তবর্তী একটি উপজেলা। এই সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ, চোরাচালানের রুট আর মাদক বাণিজ্যের আধিপত্য নিয়ে যার নাম বারবার আলোচনায় আসে, তিনি হলেন সীমান্ত ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত মোঃ মঈন উদ্দিন। স্বর্ণ পাচার, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, খুন, গুম থেকে শুরু করে পুলিশের ওপর হামলা—এমন কোনো অপরাধ নেই যেখানে তাঁর নাম জড়ায়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। অথচ অসংখ্য মামলা মাথায় নিয়েও তিনি বুক ফুলিয়ে চলেন, যা স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
অপরাধের সাম্রাজ্য: যেভাবে উত্থান
স্থানীয় সূত্র ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, মঈন উদ্দিনের উত্থান কোনো সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। একসময়কার সাধারণ মঈন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে ওঠেন এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁর বাবা ইন্তাজ আলী মণ্ডলও এলাকায় ‘ডাকাত’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলে জানা যায়। বাবার সেই উত্তরাধিকারকে যেন আরও বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন মঈন। সীমান্ত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর ক্ষমতা ও প্রভাব বহুগুণে বেড়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি চেয়ারম্যানের পদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একটি ভয়ংকর অপরাধ সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভারত থেকে স্বর্ণ, মাদক, অস্ত্র চোরাচালান এবং বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের এক বিশাল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, কেউ তাঁর অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। চাঁদাবাজি ও ভূমি দখল তাঁর সিন্ডিকেটের অন্যতম আয়ের উৎস। কথিত আছে, তিনি কিছু অসাধু সাংবাদিক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের “ম্যানেজ” করে তাঁর অপরাধের সাম্রাজ্যকে সুরক্ষিত রেখেছেন।
মামলার দীর্ঘ তালিকা: কাগজে আছে, বাস্তবে নেই
মঈন উদ্দিনের অপরাধের গভীরতা বোঝা যায় তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার তালিকা দেখলে। দেশের বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক, মাদক, পুলিশের ওপর হামলা, মানবপাচার ও বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ একাধিক ধারায় মামলা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মামলা হলো:
- মাদক বাণিজ্য: ২০১২ সালে ঝিনাইদহ সদর থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। সীমান্তবর্তী এলাকায় ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক ব্যবসার অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসেবে তাঁর নাম বারবার উঠে এসেছে।
- বিশেষ ক্ষমতা আইন: ২০১০ সালে ঝিনাইদহের মহেশপুর এবং ২০১৮ সালে জীবননগর থানায় তাঁর বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়ের করা হয়।
- মানবপাচার: ২০১৯ সালে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা থানায় বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইনে দায়ের হওয়া মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি।
- পুলিশের ওপর হামলা: ২০০৮ সালে জীবননগর থানায় পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া ও হামলার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলারও আসামি মঈন।
স্থানীয়দের প্রশ্ন, এতগুলো গুরুতর মামলা মাথায় নিয়ে একজন ব্যক্তি কীভাবে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান? অভিযোগ রয়েছে, জীবননগর থানার পুলিশ প্রশাসন তাঁর বিষয়ে অবগত থাকলেও রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি ঘটনার পর অর্থের বিনিময়ে তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
প্রশাসনের ভূমিকা ও জনগণের শঙ্কা
এই অনুসন্ধানে সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে বিষয়টি উঠে এসেছে, তা হলো প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জীবননগরের এক বাসিন্দা বলেন, “মঈন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারও নেই। পুলিশকে জানিয়েও কোনো লাভ হয় না, উল্টো অভিযোগকারী বিপদে পড়ে। সে নিজেকে এলাকার ‘রাজা’ মনে করে।”
সাবেক এই চেয়ারম্যানের অপকর্মে সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তাঁর সিন্ডিকেটের কারণে যুবসমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে এবং চোরাচালানের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। যদি এখনই তাঁর লাগাম টেনে ধরা না হয়, তবে জীবননগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এখন দেখার বিষয়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এই ‘সীমান্তের ডন’-এর বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে কি না।



