জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী নির্বাচন

বিশেষ প্রতিবেদন:
বিশেষ অতিথি হিসেবে মেজর আমীন আহমেদ আফসারী (অব.), আহ্বায়ক, জাতীয় সংস্কার জোট-এর বক্তব্য:
সুধী,
আসসালামু আলাইকুম।
নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বললেই কেউ কেউ ধরে নেন আমরা নির্বাচন চাই না। তাই প্রথমেই বলে নিতে চাই—আমরা নির্বাচন চাই! অবশ্যই নির্বাচন চাই! তবে যেনতেন নির্বাচন নয়; ডামি নির্বাচন, মনোনয়ন বাণিজ্য, ভোট ডাকাতি, হত্যা বা কেন্দ্র দখলের নির্বাচন আর চাই না। মনে রাখতে হবে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই দেশের অনেক সমস্যার মূলেই ছিল “নির্বাচন”। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর পাকিস্তান ভেঙেছে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করে ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথাও আমরা ভুলে যাইনি, যার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন হয়। নবম নির্বাচনের পূর্বে ১/১১ আসে আর নির্বাচনের পর আসে স্বৈরাচারী সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়। তার পরের তিনটি নির্বাচনের কথা আমরা সবাই জানি।
আগামীতে আসছে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন, যা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ২০২৯ সালে। সেই নির্বাচনকে এগিয়ে আনার সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। এখন এই নির্বাচনকে অর্থবহ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা নিয়ে যদি কিছু বলতে চাই, তবে নির্দ্বিধায় বলতে হয়, প্রত্যাশার চেয়ে অপ্রাপ্তির পরিমাণই বেশি। প্রত্যাশা ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন, কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা সফল হয়নি।
মূল ব্যর্থতাগুলো হলো:
১. আমরা বিপ্লবী বা জাতীয় সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছি।
২. পতিত স্বৈরাচারের নিয়োগকৃত রাষ্ট্রপতিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান প্রধান, সচিব এবং প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অপসারণ করতে ব্যর্থ হয়েছি।
৩. উপযুক্ত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে ও সুযোগ্য উপদেষ্টা নিয়োগেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
৪. উল্লেখিত ব্যর্থতার কারণে সকল প্রশাসনিক ও বিচারিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আজও সাগর-রুনি হত্যা, মেজর সিনহা হত্যা ও বিডিআর হত্যার বিচার ও তদন্ত নিশ্চিত করতে পারিনি।
৫. কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি আশানুরূপ হয়নি। ভারতের নীরব আগ্রাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অনেক ক্ষেত্রে ‘র’-এর যোগসূত্র থেকে এখনো আমরা মুক্ত হতে পারিনি। দেশকে এখনো আমরা দালালমুক্ত করতে পারিনি।
৬. জুলাই ঘোষণা ও সনদ যথাসময়ে যথোপযুক্তভাবে উপস্থাপনেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
৭. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম সংস্কার তো হয়ইনি, বরং তাদের অনেকেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব ভাগাভাগিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কোনো কোনো দল চাঁদাবাজি, রাহাজানি, অন্তর্দ্বন্দ্ব, ধর্ষণ, এমনকি খুনখারাবিতেও জড়িয়ে পড়েছে। প্রিয় মাতৃভূমিকে আমরা চাঁদামুক্ত করতে পারিনি।
৮. গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী জাতীয় ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য অটুট রাখতে ব্যর্থ হয়েছি।
৯. শহীদদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণে, তাঁদের সঠিক মর্যাদা প্রদানে এবং আহতদের সময়মতো যথোপযুক্ত চিকিৎসা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
এবার কিছু সাফল্যের কথাও শোনা যাক:
১. জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা বাকস্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি। মুক্তমনে কথা বলতে পারছি, সরকারের সমালোচনা করতে পারছি। যদিও ইদানীং কিছু ক্ষেত্রে সেলফ সেন্সরশিপও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
২. বৈদেশিক সম্পর্ক, কূটনীতি এবং বিশ্ব-বাণিজ্য নীতিতে পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে। রিজার্ভসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচকে উন্নতি ও স্থিতিশীলতা এসেছে।
৩. কিছু নিরাপত্তাচুক্তিসহ আন্তঃদেশীয় নিরাপত্তা সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস সম্ভব হয়েছে।
৪. ১১টি কমিশন গঠনের মাধ্যমে সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি সীমিত আকারের লিখিত পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব হয়েছে, তবে তার বাস্তবায়ন এখনো দৃশ্যমান নয়।
৫. আশার বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলোতে সংস্কার না হলেও দেশের মালিক “জনগণের” মধ্যে একটি বড় ধরনের সংস্কার পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর তা হলো—এই দেশে আর কোনো স্বৈরাচারকে বরদাস্ত না করার মানসিকতা তৈরি হয়েছে।
৬. তথাকথিত ছোট ও মাঝারি দলগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মনোভাব তৈরি হয়েছে।
৭. সশস্ত্রবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, অবসরপ্রাপ্ত আমলা এবং সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্যে দেশের স্বার্থে রাজনীতিতে অবদান রাখার আগ্রহ কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
৮. সাধারণ মানুষের মধ্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। এমনকি মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে।
৯. নারী, শিশু ও তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক সচেতনতাবোধের উন্নয়ন ঘটেছে।
১০. সশস্ত্রবাহিনী, বিজিবি ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ জনগণের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে।
সার্বিকভাবে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের মাঝে দেশপ্রেম ও নাগরিক দায়িত্ববোধের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে এবং এতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো, তারা দেশের শত্রু চিহ্নিত করতে এবং এ বিষয়ে সকলকে আরও সচেতন ও উজ্জীবিত করতে পেরেছে।
পরিশেষে বলতে চাই, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি যা-ই হোক, এখন আমাদের করণীয় হলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন বাংলাদেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা “জাতীয় সংস্কার জোট”-এর কার্যক্রম শুরু করেছি।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
জুলাই-আগস্টের বিপ্লবী বিজয়ের পর রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমরা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছি, যা হতাশাজনক। ক্ষমতার মোহে আমরা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা ভুলে গিয়ে পুনরায় অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করি—
- সংস্কারবিহীন নির্বাচন, গণতন্ত্রের নির্বাসন!
- সংস্কারবিহীন নির্বাচন, স্বৈরতন্ত্রের পুনর্বাসন!
অতএব, আমরা সংস্কারপন্থী সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ব্যক্তিকে একত্রিত করে সংস্কার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে “নতুন বাংলাদেশ” বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে বদ্ধপরিকর। যদি আপনারা বিশ্বাস করেন যে, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে দেশ ও জাতির কোনো পরিবর্তন হবে না এবং শহীদের রক্ত বৃথা যাবে, তবে আমাদের এই প্রচেষ্টার সাথে যোগ দিন।
সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আমাদের প্রস্তাবনা:
১. বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের দ্বারা সরকার পুনর্গঠন করতে হবে।
۲. কালক্ষেপণ না করে সংস্কারের দৃশ্যমান অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে।
۳. অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরপেক্ষ নয়, বরং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সরকার হিসেবে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে।
৪. জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচন পিআর (PR) পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত করতে হবে।
৫. আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বাহিনীর দ্রুত সংস্কার ও পুনর্গঠন নিশ্চিত করতে হবে।
৬. জুলাই অভ্যুত্থানে আহত সংগ্রামীদের চিকিৎসা ও নিরাপত্তাসহ সকল বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও দৃশ্যমান সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।
۷. সকল অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈষম্যহীনভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
۸. মানবতা, বস্ত্র, খাদ্য, নিরাপত্তাসহ দশটি বিষয়ে স্থায়ী কমিশন গঠন করে একটি মানবিক ও নৈতিক সমাজ গঠনের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
۹. সশস্ত্রবাহিনীর সংস্কার ও আধুনিকায়নে উদ্যোগ নিতে হবে।
۱۰. নির্বাচনের ৩ মাস পূর্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, নইলে এই সরকার ও নির্বাচন বিতর্কিত হবে।
সবাইকে ধন্যবাদ।



