
অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক:
ঢাকার সাভার এখন দুর্নীতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। পৌরসভা কার্যালয় থেকে শুরু করে সরকারি খাদ্য গুদাম ও ওএমএস ডিলার নিয়োগ পর্যন্ত সবখানেই অনিয়ম এবং ঘুষের বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফাইল আটকে রেখে কর্মকর্তাদের ঘুষ আদায়, টিসিবির পণ্য চুরি করে বাজারে বিক্রি এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ডিলারশিপ দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।
গত ২০ আগস্ট সাভার পৌরসভা কার্যালয়ে ঘুষের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দুই কর্মকর্তার মধ্যে প্রকাশ্য মারামারির ঘটনা ঘটে। অভিযোগ অনুযায়ী, কর আদায়কারী নাজমুল হোসেন ও নজরুল ইসলাম একটি ফাইল নিষ্পত্তির জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন। কিন্তু ফাইলটি আটকে রাখায় তাদের মধ্যে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে এই মারামারি হয়। স্থানীয়রা বলছেন, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এমন ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে।
সম্প্রতি সাভারের রাজাসন এলাকা থেকে টিসিবির পণ্য পাচারের সময় একটি ট্রাকসহ মালামাল আটক করে স্থানীয় জনতা ও সাংবাদিকরা। পরে ৯৯৯-এ কল দিয়ে বিষয়টি সাভার ডিবি পুলিশকে জানানো হলে তারা এসে মালামাল জব্দ করে। তবে এ ঘটনায় শুধুমাত্র ট্রাকচালককে আসামি করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত সপ্তাহে দৈনিক রূপালীদেশ পত্রিকার সহ-সম্পাদক জুয়েল খন্দকার স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তায় এই চোরাই পণ্যগুলো ধরতে সক্ষম হন। সাভারের রাজাসনের আল-আমিন স্কুলে অবৈধভাবে বিক্রির উদ্দেশ্যে টিসিবির পণ্য মজুদ করা হয়েছে—এই সংবাদের ভিত্তিতে সাংবাদিক জুয়েল খন্দকার অনুসন্ধান শুরু করেন। এসময় তাকে মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, “রাষ্ট্রীয় গাদ্দারদের ছাড় দেওয়া হবে না।” এরপর তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তায় প্রশাসনের মাধ্যমে চোরাই পণ্যগুলো ধরিয়ে দেন। এ নিয়ে দৈনিক রূপালীদেশ ও সংবাদ টিভি-সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
তবে মূল অভিযুক্ত ডিলার ও কর্মকর্তারা অধরা থাকায় মামলাটি সঠিকভাবে গঠন করা যায়নি। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন সাভার পৌরসভার সমাজ উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ আল মামুন, কম্পিউটার অপারেটর মোঃ সোহাবুর রহমান ও আজমা আজিজ এবং টিসিবি আঞ্চলিক অফিসের একজন কম্পিউটার অপারেটর। তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে রাতের আঁধারে সরকারি গুদাম থেকে পণ্য চুরি করে বাজারজাত করার অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া, খোলা বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয় (ওএমএস) ডিলারশিপ নিয়োগেও গুরুতর অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে। ভুয়া প্রতিষ্ঠান ও ঠিকানা ব্যবহার করে একাধিক ব্যক্তি ডিলারশিপ পেয়েছেন, যেমন:
- মোঃ মাহবুবুল হক সাব্বির (তেঁতুলঝোড়া): প্রকৃত প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই।
- নাজমুল আলম খান (হেমায়েতপুর): “সামস স্টাইলিং গার্মেন্টস” নামে দেখানো হলেও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই।
- আব্দুল্লাহ হোসেন ইউসুফ (কাউন্দিয়া): ডিলারশিপ থাকলেও কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
- সিফাতউল্লাহ (আকরাইন বাজার): প্রকৃত পরিচয় একজন মুদি দোকানদার।
- ফারজানা আক্তার লাকি (বেদে পল্লী): কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
ওএমএস নীতিমালা ২০২৪ অনুযায়ী, ভুয়া তথ্য দিয়ে ডিলারশিপ পাওয়া আইনত দণ্ডনীয়। লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী এবং ন্যূনতম ৩ টন ধারণক্ষমতার গুদাম থাকা বাধ্যতামূলক হলেও এক্ষেত্রে একটি শর্তও মানা হয়নি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সাভার পৌরসভার প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা আবু-বকর সরকারের বিরুদ্ধে দায়সারা মন্তব্যের অভিযোগ উঠেছে। উল্লেখ্য, ডিবি পুলিশ কর্তৃক টিসিবির চোরাই পণ্য আটকের পর প্রকাশিত সংবাদে এই ঘটনায় ইউএনও-র সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও আনা হয়েছিল।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, সরকারের পর্যাপ্ত তদারকির অভাবেই সরকারি দপ্তরগুলো দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। সচেতন মহল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও উচ্চপর্যায়ের কর্তৃপক্ষকে দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।



