
৫০ টাকার ভাড়া ১৩০ টাকা! সামান্য তেই ঢাকার রাস্তায় শুরু হয় ভাড়া নিয়ে অমানবিক নৈরাজ্য। প্রতিবাদ করলেই জোটবদ্ধ চালকদের হাতে হেনস্তা, কর্তৃপক্ষের নীরবতায় বাড়ছে ক্ষোভ।
নাজমুল হোসেন হামিম
ঢাকার আকাশে কালো মেঘ জমতেই রাজপথের চরিত্র বদলে যায়। এক পশলা স্বস্তির বৃষ্টি যখন নগরবাসীর মনে প্রশান্তি আনার কথা, ঠিক তখনই একদল মানুষের মুখে ফুটে ওঠে ক্রুর হাসি। ওরা আর কেউ নয়, এই শহরেরই রিকশা, সিএনজি এবং বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের চালক। বৃষ্টি তাদের জন্য আশীর্বাদ নয়, বরং অসহায় মানুষকে জিম্মি করে পকেট কাটার এক অঘোষিত লাইসেন্স।
শুক্রবার বিকেল। অফিস শেষে ঘরে ফেরার তাড়া। হঠাৎই ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি। কারওয়ান বাজারে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা শত শত মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আরমান সাহেব। উপায় না দেখে একটি সিএনজি অটোরিকশার দিকে এগিয়ে যেতেই চালক ভাড়া হাঁকলেন ৪০০ টাকা, যেখানে স্বাভাবিক সময়ে ভাড়া বড়জোর ১৫০ টাকা। প্রতিবাদ করতেই চালকের নির্লিপ্ত উত্তর, “গেলে চলেন, না গেলে নাই। লোকের অভাব নাই।”
এটি শুধু আরমান সাহেবের গল্প নয়, এটি এই শহরের লাখো মানুষের প্রতিদিনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা। সামান্য বৃষ্টি হলেই ৫০ টাকার রিকশা ভাড়া নির্দ্বিধায় ৮০-১০০ টাকা হয়ে যায়। ৮০ টাকার ভাড়া অনায়াসে পৌঁছে যায় ১৩০-১৫০ টাকায়। চালকদের ভাবখানা এমন, যেন তারা কোনো সেবা দিচ্ছেন না, বরং করুণা করছেন। তারা জানে, বৃষ্টিভেজা শরীরে অসুস্থ শিশু বা বৃদ্ধকে নিয়ে কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে না। অফিস ফেরত বা জরুরি প্রয়োজনে মানুষ তাদের দাবিকৃত ভাড়া দিতে বাধ্য। মানুষের এই অসহায়ত্বই তাদের সবচেয়ে বড় পুঁজি।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। কোনো যাত্রী অতিরিক্ত ভাড়ার প্রতিবাদ করলে চালকের হিংস্র রূপ প্রকাশ পায়। একা একজন চালককে কিছু বলতে গেলেই মুহূর্তের মধ্যে আরও পাঁচজন চালক এসে জোট বাঁধে। তাদের অলিখিত সিন্ডিকেটের দাপটের কাছে যাত্রীর সমস্ত প্রতিবাদ, তর্ক ও অনুনয় ভেসে যায়। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ থেকে শুরু করে শারীরিক হেনস্তার ঘটনাও এখন আর নতুন কিছু নয়।
তাদের এই জোটবদ্ধ শক্তির পেছনে রয়েছে এক ধরনের পেশিশক্তির নিশ্চয়তা। তারা জানে, তাদের সংগঠন বা সমিতি তাদের পাশেই দাঁড়াবে। ফলে আইন বা নীতির কোনো তোয়াক্কা তারা করে না। মানবিকতার এই পচন দেখে মনে হয়, টাকা উপার্জনের নেশায় তারা বিবেককে ছুটি দিয়ে বসে আছে। একজন ভেজা মানুষ আরেকজন মানুষের কষ্ট বুঝবে—এই স্বাভাবিক অনুভূতিটুকুও যেন এই শহর থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।
প্রশ্ন হলো, এই নৈরাজ্যের শেষ কোথায়? ভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারি নিয়ম থাকলেও তার প্রয়োগ কোথায়? কেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বৃষ্টির দিনে এই অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না? তাদের এই নীরবতা কি তবে এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে মৌন সম্মতি দিচ্ছে?
এইসব অসাধু ব্যবসায়ীদের শায়েস্তা করার সময় এসেছে। কিন্তু কীভাবে? সমাধান আমাদের হাতেই। আমাদের, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের হাতে। বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করে লাভ নেই, কারণ তাদের সিন্ডিকেট শক্তিশালী। তাই আমাদেরও এক হতে হবে।
- সম্মিলিত প্রতিবাদ: একজন নয়, দশজন মিলে যখন অতিরিক্ত ভাড়ার প্রতিবাদ করবেন, তখন চালকরা পিছু হটতে বাধ্য হবে।
- বর্জন: প্রয়োজনে কিছুক্ষণের জন্য তাদের সেবা বর্জন করুন। অল্প পথ হেঁটে যান, কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবেন না।
- সামাজিক চাপ: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ছবি ও নম্বরসহ পোস্ট করে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন।
আমাদের সম্মিলিত আওয়াজই পারে এই সিন্ডিকেটের মূলে আঘাত হানতে। যতক্ষণ না আমরা এক হয়ে রুখে দাঁড়াব, ততক্ষণ এই শহরে বৃষ্টি নামলে মানুষের চোখের জল আর আকাশের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। আজ আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি এই অমানবিকতার কাছে প্রতিদিন আত্মসমর্পণ করব, নাকি নিজেদের অধিকার আদায়ে এক হব।



