
উচ্চ জ্বর ও তীব্র গিরা ব্যথাই মূল লক্ষণ। মৃত্যুঝুঁকি কম হলেও দীর্ঘস্থায়ী পঙ্গুত্বের কারণ হতে পারে এই রোগ। মশার প্রজননস্থল ধ্বংসই প্রতিরোধের একমাত্র উপায়।
বিশেষ প্রতিবেদন:
বর্ষা মৌসুম আসতেই রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর পাশাপাশি নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে চিকুনগুনিয়া। এডিস মশাবাহিত এই রোগটি ক্রমশ এতটাই আক্রমণাত্মক হচ্ছে যে, ঘরে ঘরে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। জ্বর ও অসহনীয় ব্যথায় কাতরাচ্ছেন শিশু থেকে বয়স্ক সবাই। মৃত্যুহার কম হওয়ায় রোগটিকে অনেকে হালকাভাবে নিলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ, যা একজন সুস্থ মানুষকে महीनों বা বছরের জন্য প্রায় অচল করে দিতে পারে।
চিকুনগুনিয়া কতটা ভয়াবহ?
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের ভয়াবহতা এর মৃত্যুহার দিয়ে বিচার করলে চলবে না, বরং এর যন্ত্রণাদায়ক উপসর্গ এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব দিয়ে বিচার করতে হবে।
- তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা: চিকুনগুনিয়ার প্রধান এবং সবচেয়ে কষ্টদায়ক লক্ষণ হলো তীব্র গিরা ব্যথা (Joint Pain)। এই ব্যথা এতটাই তীব্র হতে পারে যে, রোগী হাঁটাচলা, এমনকি হাত-পা নাড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।
- দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: জ্বর সেরে যাওয়ার পরও এই ব্যথা থেকে যেতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে এই ব্যথা মাসব্যাপী, এমনকি বছরব্যাপী স্থায়ী হয় এবং ক্রনিক আর্থ্রাইটিসের মতো রূপ নেয়। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, চাকরি বা পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
- কর্মক্ষমতা হ্রাস: দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার কারণে একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি তার স্বাভাবিক কাজে ফিরতে পারেন না, যা পারিবারিক ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই রোগটি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
যেভাবে চিনবেন চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ
চিকুনগুনিয়ার লক্ষণগুলো অনেকটা ডেঙ্গুর মতো হলেও কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। এডিস মশা কামড়ানোর ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে সাধারণত লক্ষণ প্রকাশ পায়।
- হঠাৎ উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর: কোনো পূর্ব লক্ষণ ছাড়াই হঠাৎ করে ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত জ্বর আসা এর প্রধান লক্ষণ।
- তীব্র গিরা ব্যথা: জ্বরের সাথে বা পরপরই হাত ও পায়ের ছোট ছোট জয়েন্ট, যেমন—কবজি, গোড়ালি, আঙুলের গিরায় তীব্র ব্যথা শুরু হয়। অনেক সময় জয়েন্টগুলো ফুলেও যায়।
- চামড়ায় র্যাশ বা ফুসকুড়ি: জ্বর শুরু হওয়ার ২-৩ দিনের মধ্যে শরীরে, বিশেষ করে বুক, পিঠ ও হাতে লালচে র্যাশ দেখা দিতে পারে।
- অন্যান্য উপসর্গ: এর পাশাপাশি তীব্র মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, বমি বমি ভাব, অবসাদ এবং আলোর দিকে তাকাতে অসুবিধা হতে পারে।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মূল পার্থক্য
ডেঙ্গুতে গিরার ব্যথার চেয়ে শরীরে ব্যথা বেশি হয় এবং প্লাটিলেট কমে গিয়ে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে। অন্যদিকে, চিকুনগুনিয়ায় প্লাটিলেট সাধারণত স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু গিরার ব্যথা হয় অসহনীয় এবং দীর্ঘস্থায়ী।
চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচতে যা করণীয়
যেহেতু চিকুনগুনিয়ার কোনো নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন বা ওষুধ নেই, তাই প্রতিরোধই হলো বাঁচার একমাত্র উপায়। এর জন্য এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ করতে হবে।
১. মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করুন:
- বাড়ির ভেতরে বা আশেপাশে কোথাও স্বচ্ছ পানি জমতে দেবেন না। ফুলের টব, টায়ার, প্লাস্টিকের পাত্র, ডাবের খোসা, এসির জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে।
- প্রতি ৩ দিনে একবার বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করুন এবং জমে থাকা পানি ফেলে দিন।
- পানির ট্যাংক বা চৌবাচ্চা সব সময় ঢেকে রাখুন।
২. ব্যক্তিগত সতর্কতা অবলম্বন করুন:
- দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকালে ও সন্ধ্যায় ঘুমানোর সময়ও মশারি ব্যবহার করুন।
- শিশুদের ফুল হাতা ও ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখুন।
- মশা তাড়ানোর জন্য রিপেলেন্ট, কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করুন।
আক্রান্ত হলে করণীয় কী?
- দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: জ্বর বা গিরা ব্যথা দেখা দিলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হোন এটি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া নাকি সাধারণ জ্বর।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম: রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখুন।
- প্রচুর পানি ও তরল খাবার: জ্বর ও ব্যথার কারণে শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়তে পারে। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি, ফলের রস, স্যুপ ও ডাবের পানি পান করান।
- ব্যথানাশক ব্যবহারে সতর্কতা: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ব্যথানাশক, বিশেষ করে অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করবেন না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়তে পারে। জ্বরের জন্য শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ নিরাপদ।
- গিরা ব্যথার যত্ন: ব্যথার স্থানে ঠাণ্ডা বা গরম সেঁক দিলে আরাম পাওয়া যেতে পারে।
সর্বোপরি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সচেতনতাই পারে চিকুনগুনিয়ার এই ভয়াবহ বিস্তার রোধ করতে। আসুন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের ঘর ও আঙ্গিনাকে এডিসমুক্ত রাখি এবং চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ থেকে নিজেদের ও প্রিয়জনদের সুরক্ষিত রাখি।



