‘পানি খেতে দেয়নি, চোখের সামনেই মেরে ফেলল হাফেজ ছেলেকে’ ফটিকছড়িতে কিশোর হত্যায় স্বজনদের আর্তনাদ

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডে পূর্ব শত্রুতার জেরে এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয় এবং আরও দুইজন আহত হয়। নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসীর দাবি, হত্যাকারীরা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এবং আইনকে ফাঁকি দিতে নিহত কিশোর ও আহতদের ওপর ‘চোরের’ তকমা লাগানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ ঘটনায় দুইজন আটক হলেও প্রশাসনের নীরবতা ও অবহেলা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে নানা অভিযোগ উঠেছে।
শুক্রবার (২৩ আগস্ট) বিকেলে কাঞ্চননগর বিদ্যালয় মাঠে এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীরা দোষীদের শাস্তির দাবিতে এক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। এ সময় বক্তারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও ‘মব’ সৃষ্টিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের জোর দাবি জানান।
নিহত মো. রিহান মাহিন (১৪) একই এলাকার মুদি দোকানদার মোহাম্মদ লোকমানের ছেলে। এ ঘটনায় তার মা খাদিজা বেগম বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত ‘মব’ সৃষ্টিকারীরা এখন পলাতক রয়েছে। ঘটনাটি মুহূর্তেই সোশ্যাল মিডিয়া, গণমাধ্যম ও প্রিন্ট পত্রিকায় শীর্ষ আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।
নিহতের পরিবার জানায়, মাহিন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র এবং পবিত্র কুরআনের ১৮ পারার হাফেজ ছিল। সে ছিল পরিবারের একমাত্র অবলম্বন, কারণ তার অপর দুই ভাই আগেই মারা যায়। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে তার বাবা-মা ও স্বজনরা শোকে স্তব্ধ।
ঘটনাটি ঘটে গত বৃহস্পতিবার রাতে। পূর্ব শত্রুতার জেরে পরিকল্পিতভাবে চোর সন্দেহের নাটক সাজিয়ে কিশোর মাহিনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং তার সাথে থাকা আরও দুজনকে গুরুতর আহত করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনদের ভাষ্যমতে, মাহিনকে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে পানি পর্যন্ত খেতে দেওয়া হয়নি। তাকে বাঁচাতে গিয়ে স্বজনরাও হত্যাকারীদের আক্রমণের শিকার হন। এক প্রতিবেশী জানান, প্রাণ বাঁচাতে মাহিন তার বাড়িতে আশ্রয় নিলেও হত্যাকারীরা সেখান থেকে তাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায় এবং পুনরায় পেটাতে থাকে।
এ ঘটনায় মোহাম্মদ নোমান (২২) ও মোহাম্মদ আজাদ (২৩) নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে নাজিম উদ্দিন, মোহাম্মদ তৈয়ব, মহিউদ্দিনসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৭ জন পলাতক রয়েছে।
নিহত মাহিনের বাবা বলেন, “আমি গরিব মানুষ। আমার একমাত্র সন্তান ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি আর কিছু চাই না, আমার ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।”
মানববন্ধনে কাঞ্চননগর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবদুল হান্নান অভিযোগ করে বলেন, “প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে এবং টাকা খুঁজছে।” প্রশাসনের এ ধরনের গাফিলতি ও নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও নানা অভিযোগ উঠেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোজাম্মেল হক বলেন, “এটি চুরির ঘটনা নয়, ধারণা করা হচ্ছে পূর্ব শত্রুতার জেরেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।”
ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুর আহমদ জানান, গ্রেপ্তারকৃত দুই আসামি ছাড়াও বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। তবে তিনি আটককৃত আসামিদের ছবি দিতে কালক্ষেপণ করেন এবং বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও ছবি বা অন্য কোনো তথ্য দেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
মানববন্ধন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় এবং মাওলানা আনিসুর রহমান চৌধুরীর পরিচালনায় দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে কর্মসূচি শেষ হয়। এলাকাবাসী ও সচেতন মহল মনে করে, প্রতিহিংসা ও বিচারের নামে ‘মব জাস্টিস’ নাগরিক জীবনকে নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।



