কৃষিবার্তাদেশপরিবেশবাংলাদেশ

হাদা টিলা গিলছে পাথরখেকো সিন্ডিকেট: কঠোর অবস্থানে প্রশাসন, ইউএনও বললেন ‘ব্যবস্থা হবে’

প্রশাসনের অভিযান সত্ত্বেও থামছে না ধ্বংসযজ্ঞ। পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা, ৭৬০ একর বনভূমি ও হাজারো কৃষকের ভাগ্য হুমকির মুখে।

বিশেষ প্রতিনিধি:

সুনামগঞ্জের ছাতকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এক প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে চলছে প্রকৃতির ওপর ভয়াবহ তাণ্ডব। উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের ‘হাদা টিলা’ নামের বিশাল এই বনভূমি থেকে প্রতিদিন অবাধে লুট হচ্ছে পাথর, বালু ও গাছ। প্রশাসনের অভিযান চললেও থামছে না এই ধ্বংসযজ্ঞ। ফলে ৭৬০ একরের এই বিশাল বনভূমি বিলীন হওয়ার পথে, যা পুরো অঞ্চলের জন্য এক অশনিসংকেত বলে মন্তব্য করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. তারিকুল ইসলাম।

কীভাবে চলছে এই ধ্বংসযজ্ঞ?

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, একটি সংঘবদ্ধ ও প্রভাবশালী চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলছে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ।

  • বিশাল কর্মীবাহিনী: প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক শ্রমিক দিয়ে চলে পাথর উত্তোলনের কাজ।
  • বিপুল পরিমাণ লুট: দৈনিক প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ঘনফুট পাথর উত্তোলন করা হয়, যা স্থানীয় বাজারে ১০০-১৫০ টাকা ঘনফুট দরে বিক্রি হচ্ছে।
  • বন উজাড়: শুধু পাথরই নয়, সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের আওতায় লাগানো হাজার হাজার গাছ কেটেও বিক্রি করে দিচ্ছে চক্রটি।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, বন বিভাগের কর্মকর্তারা সবকিছু জেনেও নীরব ভূমিকা পালন করছেন। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে কিছু শ্রমিককে আটক করা হলেও মূল হোতারা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।

প্রশাসনের অভিযান ও সীমাবদ্ধতা

অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধে উপজেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। গত ২২ আগস্ট রাতে ইউএনওর নেতৃত্বে একটি বিশেষ দল হাদা-পান্ডব এলাকায় অভিযান চালিয়ে কয়েকটি ড্রেজার নৌকা জব্দ করে। তবে অভিযানের খবর পেয়ে মূল অপরাধীরা পালিয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে, অভিযান শেষ হওয়ার পরপরই সিন্ডিকেটটি আবারও তাদের ধ্বংসলীলা শুরু করে।

পরিবেশ ও জীবিকার ওপর আঘাত

এই নির্বিচার টিলা কাটার ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ ও স্থানীয় অর্থনীতি।

  • প্রকল্প ধ্বংস: ২০০৬-০৭ সালে ১৭৫ একর জমিতে তৈরি করা সামাজিক বনায়ন প্রকল্পটি এখন পুরোপুরি ধ্বংসের পথে। গাছপালা কেটে ফেলায় টিলাগুলো ন্যাড়া হয়ে সমতল ভূমিতে পরিণত হচ্ছে।
  • কৃষিজমির ক্ষতি: টিলার বালু ও মাটি ভেসে এসে আশপাশের কৃষিজমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় কৃষক আব্দুল কুদ্দুসের মতো অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, “আমাদের চোখের সামনে ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না।”
  • পরিবেশ বিপর্যয়: পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হবে, এলাকার বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়বে এবং মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে।

কর্তৃপক্ষ যা বলছে

এ বিষয়ে বন বিভাগের কর্মকর্তা আয়ূব আলী নিজেদের অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করে বলেন, “সিন্ডিকেটটি এতটাই শক্তিশালী যে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না।”

তবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. তারিকুল ইসলাম কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই ধ্বংসযজ্ঞ গোটা অঞ্চলের জন্য বিপদ সংকেত। শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে এটি বন্ধ করা যাবে না। আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেব।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই সিন্ডিকেটকে দমন করা না যায় এবং টিলাটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তবে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলকে বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button