বোরকা কি আমাদের সংস্কৃতি?—বিতর্কের গভীরে: ধর্ম, অধিকার ও আত্মপরিচয়ের সন্ধান

ইসলামিক ডেস্ক
ধর্মীয় অনুশাসন, সাংবিধানিক অধিকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবনাচরণের অংশ হয়েও বোরখা কেন সাংস্কৃতিক বিতর্কের কেন্দ্রে? একটি গভীর বিশ্লেষণ।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং টেলিভিশন টক শো-তে একটি প্রশ্ন নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে— “বোরকা কি বাঙালি সংস্কৃতি?” এই প্রশ্নটি কেবল একটি পোশাককে কেন্দ্র করে নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধর্ম, ঐতিহ্য, সাংবিধানিক অধিকার এবং আত্মপরিচয়ের মতো গভীর বিষয়গুলো।
ইসলামের দৃষ্টিতে পর্দার তাৎপর্য
ইসলাম ধর্মে পর্দা বা হিজাবকে নারীর মর্যাদা, শালীনতা ও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এটি কোনো প্রদর্শনীর বস্তু নয়, বরং সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্যের একটি প্রকাশ। পবিত্র কুরআনের সূরা আন-নূরের ৩১ নম্বর আয়াতে নারীদের দৃষ্টি সংযত রাখা, লজ্জাস্থানের হেফাজত করা এবং নির্দিষ্ট কিছু স্বজন ছাড়া অন্যদের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ না করার জন্য স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বোরকা, হিজাব বা আবায়া—এই সবই সেই নির্দেশের প্রায়োগিক রূপ, যা যুগ যুগ ধরে মুসলিম নারীরা পালন করে আসছেন।
সাংবিধানিক অধিকার ও আইনি সুরক্ষা
‘সংস্কৃতি’র বিতর্ক তোলার আগে বাংলাদেশের সংবিধান কী বলছে, তা দেখে নেওয়া জরুরি। সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদ প্রত্যেক নাগরিককে নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের স্বাধীনতা দিয়েছে। এই অধিকারের মধ্যে পোশাকের স্বাধীনতাও অন্তর্ভুক্ত। অতীতে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতও এক পর্যবেক্ষণে হিজাব বা বোরকা পরাকে একজন নারীর সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতরাং, ব্যক্তিগত পছন্দের এই পোশাককে সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা সাংবিধানিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল।
সংস্কৃতির সংজ্ঞা ও বাঙালি মুসলমানের ঐতিহ্য
সংস্কৃতি কোনো স্থির বা আরোপিত বিষয় নয়; এটি একটি জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এক প্রবহমান ধারা। একটি সমাজের মানুষের বিশ্বাস, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ও রুচি—এই সবকিছুই সংস্কৃতির অংশ। সেই বিবেচনায়, বাঙালি মুসলমান সমাজে বহু প্রজন্ম ধরে শালীন পোশাকের যে চর্চা চলে আসছে, বোরকা তারই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারও জন্য এটি ধর্মীয় আবশ্যকতা, কারও জন্য নিরাপত্তা, আবার কারও জন্য এটি পারিবারিক ঐতিহ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনচর্চাই যদি সংস্কৃতির ভিত্তি হয়, তবে বোরকা নিঃসন্দেহে এদেশের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বিকল্প প্রশ্ন ও বিতর্কের দ্বিমুখীতা
বিতর্কের কেন্দ্রে যখন কেবল বোরকাকে রাখা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই কিছু পাল্টা প্রশ্ন সামনে আসে। যেমন:
- জিন্স, টি-শার্ট বা পশ্চিমা পোশাকগুলো কবে থেকে আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো?
- শাঁখা-সিঁদুর বা অন্য কোনো ধর্মীয় প্রতীক নিয়ে কেন এমন প্রশ্ন তোলা হয় না?
- সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে যদি সংস্কৃতি নির্ধারিত হয়, তাহলে এ দেশে বোরকা পরিধানকারী নারীর সংখ্যা কি উপেক্ষণীয়?
সমালোচকদের মতে, এই বিতর্ক একপেশে এবং নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর জীবনাচরণকে লক্ষ্য করেই পরিচালিত হচ্ছে, যা সমাজে বিভেদ তৈরি করছে।
উপসংহার: বিতর্ক হোক শালীনতার পক্ষে
বোরকা কোনো আধুনিক ‘ফ্যাশন ট্রেন্ড’ নয় যে সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাবে। এটি শত শত বছরের বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের ধারক। যারা এই পোশাককে বাঙালি সংস্কৃতি থেকে আলাদা করতে চান, তারা মূলত এ দেশের মানুষের জীবনাচরণ ও বিশ্বাসের বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করছেন।
বিতর্ক বা আলোচনা হতেই পারে, তবে তা হওয়া উচিত গঠনমূলক। কোনো নির্দিষ্ট পোশাককে আক্রমণ না করে, বরং সমাজে ক্রমবর্ধমান অশালীনতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে আলোচনা হওয়াটাই এখন সময়ের দাবি। অন্যের অধিকার ও পছন্দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াই একটি সভ্য সমাজের পরিচায়ক।



