বিশ্ব

গাজায় নিহত সাংবাদিক মরিয়মের করুণ বিদায়।

নাসের হাসপাতালে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ভিজ্যুয়াল জার্নালিস্ট মরিয়ম আবু দাক্কা। বাবার জীবন বাঁচাতে কিডনি দান থেকে শুরু করে নিজের ভাইয়ের মৃত্যুর দৃশ্য ধারণ— এক অদম্য সাহসী মায়ের জীবনযুদ্ধের করুণ অবসান।

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে যিনি তুলে আনতেন অনাহার, অপুষ্টি আর বেঁচে থাকার সংগ্রামের করুণ আখ্যান, সেই সাহসী সাংবাদিকের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দিল ইসরায়েলি বোমা। সম্প্রতি খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন ৩৩ বছর বয়সী ভিজ্যুয়াল জার্নালিস্ট মরিয়ম আবু দাক্কা। তিনি ছিলেন সেই হাসপাতালেই কর্মরত আরও চার সাংবাদিকের একজন, যারা সত্য তুলে ধরার অপরাধে জীবন দিলেন।

সাংবাদিকতার আড়ালে এক অসাধারণ জীবন

মরিয়ম আবু দাক্কা কেবল একজন সাংবাদিক ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন মা, একজন আত্মত্যাগী কন্যা এবং ইসরায়েলি নৃশংসতার এক জীবন্ত সাক্ষী। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যারাবিয়ার মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের জন্য তিনি গাজার মানবিক বিপর্যয়, বিশেষ করে ক্ষুধায় কাতর শিশুদের মর্মস্পর্শী চিত্রগুলো বিশ্বের সামনে তুলে ধরছিলেন।

যুদ্ধের ভয়াবহতা শুরুর আগেই মরিয়ম মানবতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি একটি কিডনি দান করে বাঁচিয়েছিলেন প্রিয় বাবার জীবন। যুদ্ধের ডামাডোলে নিজের একমাত্র সন্তান, ১৩ বছর বয়সী ছেলে গায়েসের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। নিজে রয়ে গিয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায়, বিপন্ন মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠার জন্য।

ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি থেকে সত্যের পথে যাত্রা

সাংবাদিকতার জগতে মরিয়মের প্রবেশ ছিল এক হৃদয়বিদারক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ২০১৮ সালে ‘গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন’ বিক্ষোভে ইসরায়েলি স্নাইপারের গুলিতে এক ফিলিস্তিনি তরুণের মৃত্যুর দৃশ্য তিনি ক্যামেরাবন্দী করেন। সেই মুহূর্তের বীভৎসতা ধারণ করার পর তিনি জানতে পারেন, নিহত ব্যক্তিটি ছিলেন তার নিজেরই ভাই। এমন ব্যক্তিগত আঘাত তাকে বিচলিত করলেও দমাতে পারেনি। ভাইয়ের মৃত্যুই যেন তাকে সত্য প্রকাশের পথে আরও অবিচল করে তোলে। এরপর থেকে তিনি গাজার প্রতিটি অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধে তার ক্যামেরাকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে গেছেন।

যে হাসপাতাল ছিল কর্মস্থল, সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস

সহকর্মীদের কাছে মরিয়ম ছিলেন সাহস ও অনুপ্রেরণার এক বাতিঘর। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রায়ই নাসের হাসপাতালে অবস্থান করতেন। সেখান থেকেই তিনি বাস্তুচ্যুত মানুষের দুর্ভোগ, আহতদের আর্তনাদ এবং অনাহারে বিবর্ণ শিশুদের বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকদের মরিয়া চেষ্টার চিত্র ধারণ করতেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেও যে হাসপাতাল থেকে তিনি শিশুদের অনাহার নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন, সেই হাসপাতালের প্রাঙ্গণেই ইসরায়েলি বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার নিথর দেহ।

আন্তর্জাতিক নিন্দা ও বিচার দাবি

সাংবাদিকদের ওপর এই নৃশংস হামলার ঘটনায় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা মরিয়মের মৃত্যুকে এক “হৃদয়বিদারক ও ক্ষোভজনক” হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করেছেন। তার এই আত্মত্যাগ আবারও প্রমাণ করল, সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে গাজায় সাংবাদিকরা কতটা ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে কাজ করছেন। মরিয়মের অসমাপ্ত কাজ আর তার রেখে যাওয়া প্রশ্নগুলোই এখন বিশ্ববিবেকের কাছে বিচার চেয়ে যাবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button