ইল্লিন ও সিজ্জিন: মৃত্যুর পর মানুষের আত্মার দুই ভিন্ন গন্তব্য

ইসলামিক ডেস্ক: এক অনিবার্য সত্য, যার পর শুরু হয় মানুষের অনন্ত জীবন। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা কর্মফল অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে অবস্থান করে। পবিত্র কুরআনে এমনই দুটি স্থানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে—’ইল্লিন’ ও ‘সিজ্জিন’। একটি হলো পুণ্যবানদের জন্য নির্ধারিত শান্তিময় স্থান, আর অন্যটি পাপাচারীদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক বন্দিদশা। আসুন, কুরআন ও হাদিসের আলোকে এই দুটি স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক
ইল্লিন: পুণ্যবানদের আত্মার প্রশান্তির ঠিকানা
‘ইল্লিন’ একটি আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ ঊর্ধ্ব জগৎ বা সম্মানিত স্থান। ইসলামি পরিভাষায়, এটি পুণ্যবান বা নেককার বান্দাদের আমলনামা বা তাদের আত্মার আবাসস্থলকে বোঝায়। যখন একজন মুমিন ঈমানের সঙ্গে সৎকর্ম করে মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার আত্মাকে এই সম্মানিত স্থানে রাখা হয়।
কুরআনের আলোকে ইল্লিন
পবিত্র কুরআনের সূরা আল-মুতাফফিফিনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“কখনই নয়, নিশ্চয় পুণ্যবানদের আমলনামা আছে ইল্লিনে। আর আপনাকে কিসে জানাবে যে, ইল্লিন কী? তা এক লিপিবদ্ধ কিতাব। আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্তরাই তা প্রত্যক্ষ করে।” (আয়াত: ১৮-২১)
এই আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায়, ‘ইল্লিন’ কেবল একটি স্থানই নয়, বরং এটি পুণ্যবানদের আমলের একটি সুসংরক্ষিত দফতর, যা আল্লাহর নিকটবর্তী ফেরেশতারা পাহারা দেন। এখানে আত্মাসমূহ কিয়ামত পর্যন্ত পরম শান্তিতে অবস্থান করে।
তাসাউফ ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা
ইসলামের আধ্যাত্মিক সাধক বা অলি-আল্লাহগণ বলেন, ইল্লিন হলো সেই আধ্যাত্মিক স্তর, যেখানে মুমিনের আত্মা তার জীবনের ভালো কাজগুলোর প্রতিদানস্বরূপ এক অনাবিল শান্তি ও সন্তুষ্টি অনুভব করে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য একটি বিশেষ সম্মাননা।
সিজ্জিন: পাপাচারীদের আত্মার বন্দিশালা
‘ইল্লিন’-এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা হলো ‘সিজ্জিন’। আরবি ‘সিজনুন’ শব্দ থেকে আগত ‘সিজ্জিন’-এর অর্থ কারাগার বা সংকীর্ণ স্থান। এটি পাপাচারী, কাফির ও সীমা লঙ্ঘনকারীদের আত্মার ঠিকানা। যারা দুনিয়ায় আল্লাহর আদেশ অমান্য করে এবং পাপাচারে লিপ্ত থেকে মৃত্যুবরণ করে, তাদের আত্মাকে এখানে বন্দি করে রাখা হয়।
কুরআনের আলোকে সিজ্জিন
সূরা আল-মুতাফফিফিনের শুরুতেই সিজ্জিন সম্পর্কে বলা হয়েছে:
“কখনই নয়, নিশ্চয় পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জিনে আছে। আর আপনাকে কিসে জানাবে যে, সিজ্জিন কী? তা এক লিপিবদ্ধ কিতাব।” (আয়াত: ৭-৯)
এই আয়াত অনুযায়ী, ‘সিজ্জিন’ হলো পাপীদের আমলনামার একটি তালিকা এবং তাদের আত্মার জন্য এক যন্ত্রণাদায়ক বন্দিশালা। এটি নিম্নতম স্তরের একটি স্থান, যেখানে আত্মারা চরম অশান্তি ও কষ্ট ভোগ করতে থাকে।
আধ্যাত্মিক perspectiva
তাসাউফের দৃষ্টিতে, যে আত্মা ঈমানহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, সে আল্লাহর রহমত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তার আত্মা পৃথিবীতে তার দেহের কাছে ফিরে আসতে চাইলেও পচনশীল দেহে আশ্রয় পায় না। এই নিরাশ্রয় ও যন্ত্রণাময় অবস্থাই হলো সিজ্জিনের যন্ত্রণা। তবে ইসলামে তওবার দরজা সর্বদা খোলা। জীবদ্দশায় কেউ যদি искренне অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর পথে ফিরে আসে এবং কোনো কামেল ব্যক্তির নির্দেশনা অনুসরণ করে, তবে এই কঠিন পরিণতি থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব।
শেষ কথা
ইল্লিন ও সিজ্জিনের ধারণা মুমিনদের জন্য একটি বড় শিক্ষা। এটি একদিকে যেমন সৎকাজের প্রতি উৎসাহিত করে, তেমনি পাপকাজ থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করে। প্রতিটি মানুষের কর্মফলই নির্ধারণ করবে তার মৃত্যুর পরবর্তী গন্তব্য—সে কি ইল্লিনের প্রশান্তি লাভ করবে, নাকি সিজ্জিনের যন্ত্রণায় নিক্ষিপ্ত হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইল্লিনবাসী হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।



