ইসলাম ধর্ম

কোরআন ও হাদিসের আলোকে জিহাদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ইসলামিক ডেস্ক: ‘জিহাদ’—ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিভাষা, যা প্রায়শই ভুলভাবে উপস্থাপিত ও সীমিত অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়। ‘জিহাদ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ কোনো কিছু অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা, সাধনা বা সংগ্রাম করা। ইসলামী পরিভাষায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দ্বীনকে সমুন্নত করতে এবং অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম করার নামই জিহাদ। এটি শুধু सशस्त्र সংগ্রাম নয়, বরং এর পরিধি আরও অনেক ব্যাপক।

কুরআনের আয়াত:

  • সূরা আস-সফ, আয়াত: ১১“তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনো এবং আল্লাহর পথে তোমাদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে জিহাদ করো। এটাই তোমাদের জন্য অতীব কল্যাণকর, যদি তোমরা তা জানতে।”
    তাফসির: এই আয়াতে দ্বীন ইসলাম রক্ষার জন্য ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করা ফরয হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইমাম যুহরী (রহ.) বলেন, প্রত্যেক মুসলিমের ওপর জিহাদ ফরয—সে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করুক বা নিজ অবস্থানে থেকে মুজাহিদদের সাহায্য করুক। প্রয়োজনে যুদ্ধের ময়দানে যোগদানের আহ্বান করা হলে তাতে সাড়া দেওয়া আবশ্যক।
  • সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৬“তোমাদের ওপর যুদ্ধের বিধান দেওয়া হয়েছে, যদিও তা তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর। কিন্তু হতে পারে কোনো জিনিস তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার হতে পারে, কোনো জিনিস তোমরা পছন্দ করো অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।”
  • সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৮“নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা করে। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
  • সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৯৫“মুমিনদের মধ্যে যারা কোনো সঙ্গত কারণ ছাড়া ঘরে বসে থাকে, তারা আর যারা আল্লাহর পথে নিজেদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে জিহাদ করে, তারা সমান নয়। যারা ঘরে বসে থাকে, তাদের তুলনায় যারা নিজেদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে জিহাদ করে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। আল্লাহ উভয়ের জন্যই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে যারা ঘরে বসে থাকে, তাদের তুলনায় মুজাহিদদের জন্য আল্লাহ মহাপুরস্কার রেখেছেন।”
  • সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৭৪“যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে ও আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে এবং যারা আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তারাই প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা।”
  • সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ২০“যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে নিজেদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে জিহাদ করেছে, আল্লাহর কাছে তারাই সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। আর তারাই সফলকাম।”
  • সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ২৪“(হে নবী) বলুন, ‘যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যার মন্দার আশঙ্কা তোমরা করো এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ করো—এগুলো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা করো যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে আসেন। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়েত দেন না’।”
  • সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৪১“তোমরা অভিযানে বের হও, হালকা অবস্থায় হোক বা ভারী অবস্থায়, এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে নিজেদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা জানতে।”
  • সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৫“তারাই তো প্রকৃত মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর কোনো সন্দেহ পোষণ করে না এবং নিজেদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে। তারাই সত্যবাদী।”
  • সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ১০“তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করছো না? অথচ আসমান ও জমিনের মালিকানা তো আল্লাহরই। তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছ ও যুদ্ধ করেছ, তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়। তাদের মর্যাদা ওদের চেয়ে অনেক বেশি, যারা বিজয়ের পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ উভয়ের জন্যই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তোমরা যা করো, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।”
  • সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৯“হে নবী! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের প্রতি কঠোর হোন। তাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম, আর তা কতই না নিকৃষ্ট ঠিকানা।”
  • সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩৯“আর তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা (শিরক ও অত্যাচার) দূরীভূত হয় এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়।”
  • সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৭৬“যারা ঈমানদার, তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। আর যারা কাফির, তারা তাগুতের (শয়তানের) পথে যুদ্ধ করে। সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল অত্যন্ত দুর্বল।”
  • সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৪২“তোমরা কি মনে করেছ যে, তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা (তাঁর পথে) জিহাদ করে এবং কারা ধৈর্যশীল।”

হাদিসের আলোকে জিহাদ:

  • সর্বোত্তম আমল: আবূ যর (রা.) নবী (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন আমল সর্বোত্তম?” তিনি বললেন, “আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং মহান আল্লাহর পথে জিহাদ করা।” (সুনানে আন-নাসায়ী: ৩১২৯)
  • জিহাদের বিভিন্ন রূপ: আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের সম্পদ দ্বারা, জীবন দ্বারা এবং জিহ্বা দ্বারা (মুশরিকদের বিরুদ্ধে) জিহাদ করো।” (সুনানে আবু দাউদ: ২৫০৪, সুনানে আন-নাসায়ী: ৩১৯২)
  • শ্রেষ্ঠ জিহাদ: এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করলো, “কোন জিহাদ সর্বোত্তম?” তিনি বললেন, “অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলা।” (সুনানে আন-নাসায়ী: ৪২০৯)
  • জিহাদ থেকে বিমুখতার পরিণাম: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যখন তোমরা ‘ঈনা’ পদ্ধতির (সুদভিত্তিক) ক্রয়-বিক্রয় শুরু করবে, গরুর লেজ আঁকড়ে ধরবে (অর্থাৎ কৃষিকাজেই সন্তুষ্ট থাকবে) এবং জিহাদ ছেড়ে দেবে, তখন আল্লাহ তোমাদের ওপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেবেন এবং তা দূর করবেন না, যতক্ষণ না তোমরা নিজেদের দ্বীনের দিকে ফিরে আসবে।” (মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবু দাউদ)
  • মুনাফিকের আলামত: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মারা গেল অথচ সে জিহাদ করেনি এবং অন্তরে জিহাদ করার আকাঙ্ক্ষাও পোষণ করেনি, সে মুনাফিকের একটি শাখায় মৃত্যুবরণ করল।” (রিয়াদুস সালেহিন: ১৩৪৯)
  • মুজাহিদের মর্যাদা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “আল্লাহর পথে একটি সকাল কিংবা একটি বিকাল অতিবাহিত করা দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে, তার চেয়েও উত্তম।” (সহিহ বুখারি: ২৭৯২)
  • ধূলিমলিন পায়ের পুরস্কার: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “আল্লাহর পথে যে বান্দার দুই পা ধূলিমলিন হয়, তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।” (সহিহ বুখারি: ২৮১১)
  • শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষার প্রতিদান: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর কাছে শাহাদাত প্রার্থনা করবে, আল্লাহ তাকে শহীদদের মর্যাদায় পৌঁছিয়ে দেবেন, যদিও সে নিজ বিছানায় মৃত্যুবরণ করে।” (রিয়াদুস সালেহিন: ১৩২৯)
  • শহীদের পুরস্কার: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “শহীদকে ছয়টি পুরস্কার দেওয়া হয়: (১) তার রক্তের প্রথম ফোঁটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই তার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়, (২) তাকে তার জান্নাতের স্থান দেখানো হয়, (৩) তাকে হুরদের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়, (৪) সে (কিয়ামতের দিনের) ভয়াবহতা থেকে নিরাপত্তা লাভ করে, (৫) তাকে কবরের শাস্তি থেকে রক্ষা করা হয় এবং (৬) তাকে ঈমানের পোশাকে ভূষিত করা হয়।” (মুসনাদে আহমাদ)
  • শহীদের শাফায়াত: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “শহীদ তার পরিবারের সত্তর জনের জন্য শাফায়াত করার সুযোগ পাবে এবং তার সুপারিশ কবুল করা হবে।” (সুনানে আবু দাউদ: ২৫২২)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button