বিশেষ প্রতিনিধি: হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, নদীমাতৃক প্রকৃতির অপরূপ শোভা এবং গৌরবোজ্জ্বল মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ। অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশটি আজ রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির সংকটে জর্জরিত, যা এর উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণ না ঘটলে “সোনার বাংলা” গড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
সৌন্দর্যের আড়ালে সংকটের ছায়া
দক্ষিণ এশিয়ার বুকে এক পান্না সবুজ ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। এর ইতিহাস ত্যাগের এবং গৌরবের। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন—প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাঙালি জাতি নিজেদের শক্তির পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার কয়েক দশক পরেও দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা আশানুরূপভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ক্ষমতার লড়াই, অসহিষ্ণুতা, দুর্নীতি এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি দেশের সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিচ্ছে।
কেন এই রাজনৈতিক অবক্ষয়?
মোঃ ইকবাল হোসেন সরদার, যিনি আগামী জাতীয় নির্বাচনে শরীয়তপুর-৩ আসন থেকে একজন নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন, তার এক লেখায় এই রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কিছু মূল কারণ চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, প্রধান কারণগুলো হলো:
- গণতন্ত্রের সংকট: রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা নেই বললেই চলে। শীর্ষ নেতৃত্বের একক সিদ্ধান্তে দল পরিচালিত হওয়ায় তৈরি হয়েছে এক ধরনের দলীয় স্বৈরাচার।
- অসহিষ্ণুতার রাজনীতি: বিরোধী মতকে দমন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রু ভাবার সংস্কৃতি প্রতিহিংসার জন্ম দিচ্ছে, যা প্রায়ই সহিংসতায় রূপ নেয়।
- রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ: রাজনীতি এখন আর জনসেবার ক্ষেত্র নয়, বরং প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও গোষ্ঠীর জন্য বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা ও অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
- পরিবারতন্ত্রের প্রভাব: যোগ্যতা নয়, বরং পারিবারিক পরিচয়ে শীর্ষ নেতৃত্বে আসার প্রবণতা গণতন্ত্রের মূল চেতনাকে আঘাত করছে। এতে জনগণের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি বা পরিবারের এজেন্ডা বাস্তবায়িত হচ্ছে।
- দুর্বল আইনের শাসন: আইন প্রয়োগে পক্ষপাতিত্ব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের উৎসাহিত করছে, যা সুশাসনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী?
এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে একটি সমন্বিত পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। উত্তরণের উপায় হিসেবে তারা কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছেন:
- রাজনৈতিক সংস্কার: দলগুলোকে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চায় বাধ্য করতে হবে এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সংলাপ ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে।
- সুশাসন প্রতিষ্ঠা: দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
- নতুন নেতৃত্বের বিকাশ: তরুণ, শিক্ষিত ও সৎ ব্যক্তিদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলতে হবে। অর্থ ও পেশিশক্তির পরিবর্তে মেধা, যোগ্যতা ও জনসেবার মানসিকতাকে রাজনীতিতে প্রবেশের মানদণ্ড করতে হবে।
- নাগরিক সচেতনতা: গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অধিকার সম্পর্কে জনগণকে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করতে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। পাশাপাশি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে এবং নাগরিক সমাজকে সক্রিয় ভূমিকার সুযোগ দিয়ে একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।
শেষ কথা
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এবং কর্মঠ মানুষের এই দেশ সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিচালিত হলে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি মডেল হয়ে উঠতে পারে। ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্য, সুশাসন এবং একটি সহনশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলেই বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। আর তবেই বিশ্বমঞ্চে এক উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।



