সার্বজনীন নৈতিকতার আয়নায় মুহাম্মদ (সা.): একালের চোখে মহাপুরুষের বিচার
ইসলামিক ডেস্ক: ইতিহাসের যেকোনো চরিত্রকে বিচার করার দুটি মানদণ্ড থাকতে পারে—একটি হলো তাঁর সমসাময়িক প্রেক্ষাপট, অন্যটি আধুনিক বা সার্বজনীন নৈতিকতার মানদণ্ড। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে প্রচলিত সমালোচনা ও তাঁর অনুসারীদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে, একবিংশ শতাব্দীর মূল্যবোধ দিয়ে তাঁকে কীভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব?
ঐতিহাসিক বনাম সার্বজনীন মানদণ্ড
প্রখ্যাত গবেষক মন্টগোমারি ওয়াট তাঁর ‘মদিনায় মুহাম্মদ’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, সমসাময়িক আরবের প্রেক্ষাপটে মুহাম্মদ (সা.) শত্রু-মিত্র উভয়ের কাছেই একজন সজ্জন ও সাধুপুরুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু আধুনিক যুগে তাঁকে বিচার করতে গেলে সামনে আসে “সার্বজনীন নৈতিকতার মানদণ্ড”-এর ধারণা। ওয়াটের মতে, এখানেই মূল জটিলতা।
প্রথমত, আদৌ কি বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত কোনো একক নৈতিক মানদণ্ড আছে? ‘সদা সত্য বলা’ বা ‘প্রাণীহত্যা মহাপাপ’—এর মতো আপাতসরল নীতিগুলোও স্থান-কাল-পাত্রভেদে আপেক্ষিক হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে তাঁর নিজস্ব আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন করে সম্পূর্ণ আধুনিক মানদণ্ডে বিচার করা কতটা যৌক্তিক? প্রতিটি মানুষই তাঁর সময়ের সন্তান, এবং সেই সময়ের মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে পুরোপুরি অতিক্রম করা প্রায় অসম্ভব।
কোরআনের দৃষ্টিতে মুহাম্মদ (সা.): ‘সুন্দরতম আদর্শ’
মজার বিষয় হলো, কোরআন নিজেও মুহাম্মদ (সা.)-কে একজন মানুষ হিসেবেই উপস্থাপন করেছে। বিভিন্ন আয়াতে তাঁর মানবসুলভ সীমাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যা তাঁকে অতিমানবীয় বা নিষ্কলঙ্ক সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবিকে খণ্ডন করে।
তবে একই সাথে কোরআন তাঁর চরিত্রকে বিশ্বাসীদের জন্য ‘উসওয়াতুন হাসানাহ’ বা ‘অন্যতম সুন্দর আদর্শ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে (সূরা আহযাব: ২১)। ভক্ত মুসলমানরা এই আয়াতকে ভিত্তি করে তাঁকে মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাঙ্গসুন্দর আদর্শ বলে দাবি করেন। এই দাবি একাধারে বিশ্বের সব মত ও পথের মানুষকে আমন্ত্রণ জানায় মুহাম্মদ (সা.)-কে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার জন্য।
বিশ্বসভায় মুহাম্মদকে উপস্থাপনের দায় কার?
আজকের বিশ্বায়নের যুগে মুসলিম বিশ্বের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ও আদর্শ নিয়ে আলোচনা ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। প্রশ্ন হলো, তাঁর জীবন থেকে কি এমন কোনো শিক্ষা পাওয়া সম্ভব, যা ভবিষ্যতের একটি একীভূত বিশ্বনৈতিকতার ভিত্তি গড়তে সাহায্য করবে?
এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অস্পষ্ট। কারণ, মুসলমানরা যেমন তাঁদের দাবিকে বিশ্বের কাছে convincing-ভাবে তুলে ধরতে পারেননি, তেমনি অমুসলিম বিশ্বও এই আলোচনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারেনি। তবে এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে মূলত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারীদের ওপর। তারা কি পারবেন—
- তাঁর জীবনের বিশেষ প্রেক্ষাপট থেকে সার্বজনীন নীতিগুলো আবিষ্কার করতে?
- বর্তমান বিশ্বের সংকট নিরসনে একটি সৃজনশীল নৈতিক কাঠামো উপস্থাপন করতে?
- অথবা অন্তত তাঁকে বিশ্বনৈতিকতায় একজন আদর্শ মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে?
মুসলমানদের আত্মজিজ্ঞাসা: পথ হারানো অনুসারীদের সামনে পর্বতপ্রমাণ বাধা
দুঃখজনকভাবে, এই গুরুদায়িত্ব পালনের পথে আজকের মুসলিমদের সামনে রয়েছে বিশাল প্রতিবন্ধকতা। ইসলামের মূল বাণী থেকে সরে গিয়ে তারা এমন কিছু শাস্ত্রীয় ও সাংস্কৃতিক বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন, যা আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়াচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত তারা:
- নবীকে অতিমানবীয় সত্তা বানিয়ে স্রষ্টার সমকক্ষ ভাববেন;
- কোরআনের গতিশীল ব্যাখ্যাকে হাদিস ও মধ্যযুগীয় শাস্ত্রের বেড়াজালে বন্দী রাখবেন;
- শিল্প, সাহিত্য, মুক্তচিন্তা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবেন;
- নারী, ভিন্নমতাবলম্বী ও ভিন্নধর্মের মানুষের প্রতি অসহনশীল থাকবেন;
- এবং সমালোচনার জবাবে সহিংসতার পথ বেছে নেবেন;
ততদিন বিশ্বদরবারে নৈতিকতার আলোচনায় তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
শেষ কথা
মুহাম্মদ (সা.) যে একজন দূরদর্শী সংস্কারক, মানবতাবাদী, জ্ঞানতাপস এবং সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে বৈশ্বিকতার পথে ডাক দিয়েছেন—এই বার্তাটি এখনো বিশ্বের কাছে প্রায় অজানাই রয়ে গেছে। তাঁকে ‘সমগ্র মানবজাতির জন্য আদর্শ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানানোর আগে, নিজেদের সমসাময়িক প্রতিবেশী—সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি বা নাস্তিক যেই হোক না কেন—তাদের কাছে নবীর প্রকৃত পরিচয় ও আদর্শকে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরার কাজটি এখনো বাকি রয়ে গেছে। আর এই দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতাই আজকের দিনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।



