ইসলাম ধর্ম

বিচারের দিনে জিহ্বার আর্তনাদ: যখন আপনার জিহ্বা আপনার বিরুদ্ধেই গীবতের সাক্ষ্য দেবে

ইসলামে গীবত বা পরনিন্দা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সমান অপরাধ। হাশরের ময়দানে মানুষের জিহ্বা কীভাবে তার কৃতকর্মের সাক্ষী হবে এবং এই ভয়াবহ পাপ থেকে বাঁচার উপায় কী, তা জেনে নিন।

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: কল্পনা করুন সেই দিনের কথা—হাশরের ময়দান, যেখানে পৃথিবীর সকল মানুষ বিচারের জন্য দণ্ডায়মান। পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ আপনার কথা বলার পালা এলো, কিন্তু আপনার মুখ নয়, কথা বলছে আপনার জিহ্বা। যে জিহ্বা একদিন পৃথিবীতে নির্ভীকভাবে অন্যের সমালোচনা করেছিল, আজ সে আপনার বিরুদ্ধেই আল্লাহর দরবারে সাক্ষ্য দিচ্ছে। বলছে, “হে আমার রব! এই ব্যক্তি আমাকে ব্যবহার করে তার ভাইয়ের গীবত করেছে, তার অনুপস্থিতিতে তার সম্মানহানি করেছে।”

এটি কোনো কল্পকাহিনী নয়, বরং ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী এটিই হলো পরকালের কঠিন বাস্তবতা।

গীবত কী এবং এর ভয়াবহতা

গীবত বা পরনিন্দা ইসলামে একটি কবিরা গুনাহ বা মারাত্মক পাপ। সাধারণভাবে আমরা মনে করি, কারও সম্পর্কে মিথ্যা কিছু বলাই কেবল অপরাধ। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এর সংজ্ঞা আরও ব্যাপক।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “তুমি যদি তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কিছু বলো, যা সে শুনলে অপছন্দ করবে—তাহলেই সেটা গীবত।” সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা যা বলছি, তা যদি তার মধ্যে সত্যিই থেকে থাকে?” তিনি উত্তর দিলেন, “যদি তা সত্য হয়, তবেই তা গীবত। আর যদি তা মিথ্যা হয়, তবে তা ‘বুহতান’ বা অপবাদ, যা আরও জঘন্য অপরাধ।” (সহীহ মুসলিম)

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা গীবতের ভয়াবহতা বোঝাতে এক মর্মান্তিক উপমা ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন:

“তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা ঘৃণাই করবে।” (সূরা হুজুরাত: ১২)

এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয় যে, অন্যের অনুপস্থিতিতে তার সমালোচনা করা কতটা ঘৃণ্য ও অমানবিক কাজ।

যেভাবে গীবত আপনার আমল ধ্বংস করে

গীবত কেবল একটি সামাজিক অপরাধ নয়, এটি আধ্যাত্মিকভাবেও একজন মুমিনকে দেউলিয়া করে দেয়। পরনিন্দার কারণে একজন ব্যক্তির কষ্টার্জিত ইবাদত, যেমন—নামাজ, রোজা ও সদকার পুণ্য নষ্ট হয়ে যায়। হাদিস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি অন্যের গীবত করে, তার নেক আমলগুলো সেই ব্যক্তির আমলনামায় স্থানান্তর হয়ে যায়, যার গীবত করা হয়েছে। অর্থাৎ, আপনি সারাজীবন ইবাদত করেও অন্যের সমালোচনার কারণে কিয়ামতের দিনে শূন্য হাতে উঠতে পারেন।

শ্রোতাও কি সমান অপরাধী?

গীবতের পাপ শুধু বক্তার একার নয়। যারা আগ্রহ নিয়ে গীবত শোনে, তাতে সায় দেয়, কিংবা নীরব থেকে উপভোগ করে, তারাও এই পাপে সমান অংশীদার। চায়ের দোকান, অফিস কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় যখন পরনিন্দা হয়, তখন চুপ থাকাটাও সম্মতির লক্ষণ। তাই, একজন মুমিনের দায়িত্ব হলো হয় এ ধরনের আলোচনা বন্ধ করা, অথবা সেই স্থান ত্যাগ করা।

মুক্তির পথ: জিহ্বার নিয়ন্ত্রণ

এই ভয়াবহ পাপ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো জিহ্বার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনা। প্রতিটি কথা বলার আগে চিন্তা করা উচিত—এর জন্য আমাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে কি না। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

“সে এমন কোনো কথাই উচ্চারণ করে না, যা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর তত্ত্বাবধায়ক (ফেরেশতা) তার কাছে উপস্থিত থাকে না।” (সূরা ক্বাফ: ১৮)

তাই আমাদের প্রার্থনা হওয়া উচিত: “হে আল্লাহ! আমার জিহ্বাকে তোমার যিকির ও প্রশংসায় সিক্ত রাখো এবং একে অন্যের দোষচর্চার মতো পাপ থেকে রক্ষা করো।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button