জাতীয়পরিবেশবাংলাদেশরাষ্ট্রনীতি

জমির মালিকানা: চূড়ান্ত খতিয়ানই কি শেষ কথা? আসল রহস্য লুকিয়ে খসড়া খতিয়ানে

অ্যাডভোকেট সুবর্ণা সীমা: জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ এড়াতে এবং এর মূল ইতিহাস জানতে কেন খসড়া বা ড্রাফট খতিয়ান সংগ্রহ করা জরুরি, তা জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫: বাংলাদেশে জমি সংক্রান্ত বিরোধ একটি সাধারণ সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, হাতের চূড়ান্ত খতিয়ান থাকা সত্ত্বেও জমির প্রকৃত মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু চূড়ান্ত খতিয়ানই জমির মালিকানার একমাত্র প্রমাণ নয়। জমির রেকর্ডের মূল উৎস জানতে এবং ভবিষ্যৎ আইনি জটিলতা এড়াতে ‘খসড়া খতিয়ান’ সংগ্রহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

খতিয়ান বনাম মালিকানা: সাধারণ ভুল ধারণা

আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, জমির খতিয়ান হাতে থাকা মানেই মালিকানা নিশ্চিত। কিন্তু ভূমি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খতিয়ান কেবল একটি রেকর্ড বা স্বত্বের বিবরণী। এই রেকর্ড কোন সূত্রের ভিত্তিতে—দলিল নাকি উত্তরাধিকার—প্রস্তুত হয়েছে, সেই তথ্যই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর এই মূল তথ্যটি পাওয়া যায় খসড়া বা ড্রাফট খতিয়ানে।

খসড়া খতিয়ান কী এবং কেন এটি জরুরি?

ভূমি জরিপ বা রেকর্ড প্রস্তুতের সময় যে প্রাথমিক নথি তৈরি করা হয়, তাকেই খসড়া খতিয়ান বা ড্রাফট খতিয়ান বলে।[2] এটিকে জমির ইতিহাসের প্রথম খসড়া বলা যেতে পারে, যেখানে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো থাকে:

  • রেকর্ডের উৎস: জমির বর্তমান রেকর্ডটি কি কোনো দলিলের ভিত্তিতে তৈরি, নাকি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তির কারণে হয়েছে, তার স্পষ্ট উল্লেখ থাকে।
  • দলিলের বিবরণ: যদি জমিটি দলিল মূলে রেকর্ড হয়ে থাকে, তবে সেই দলিলের নম্বর, তারিখ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য খসড়া খতিয়ানে পাওয়া যায়।
  • পূর্ববর্তী মালিক: জমির আগের মালিক কে ছিলেন, সেই তথ্যও এখানে লিপিবদ্ধ থাকে, যা মালিকানার ধারাবাহিকতা (Chain of Title) যাচাইয়ে সাহায্য করে।
  • জমির পরিমাণ: জরিপ চলাকালীন কার নামে কতটুকু জমি রেকর্ড করা হয়েছে, তার বিস্তারিত হিসাব থাকে।

উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার দাদার নামে সি.এস. রেকর্ডে কোনো জমি থাকে, কিন্তু তিনি কখনো সেই জমি কেনেননি, তবে খসড়া খতিয়ানই বলে দেবে যে তিনি জমিটি পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিলেন নাকি অন্য কোনো পুরোনো দলিলের ভিত্তিতে মালিক হয়েছিলেন।

যেভাবে সৃষ্টি হয় বিরোধ

অনেকেই চূড়ান্ত খতিয়ান পেয়ে জমির মালিকানা নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। কিন্তু খসড়া খতিয়ান যাচাই না করার ফলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে। যেমন, অন্য কোনো ব্যক্তি এসে দাবি করতে পারেন যে, তার পূর্বপুরুষের দলিল থাকা সত্ত্বেও ভুলবশত জমিটি আপনার নামে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মামলা-মোকদ্দমা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না, যা দীর্ঘ সময় ও অর্থ অপচয়ের কারণ হয়।

কোথায় পাবেন এবং কীভাবে সংগ্রহ করবেন?

জমির খসড়া খতিয়ান বা এর সার্টিফায়েড কপি আপনার জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ডরুম অথবা সংশ্লিষ্ট উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিস থেকে সংগ্রহ করা যায়। বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও কিছু খসড়া খতিয়ান অনলাইনে দেখার সুযোগ রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খসড়া খতিয়ান হলো জমির “জন্মসনদ”। তাই জমি কেনাবেচা বা মালিকানা যাচাইয়ের সময় চূড়ান্ত খতিয়ানের পাশাপাশি খসড়া খতিয়ান সংগ্রহ ও যাচাই করা অপরিহার্য। এর মাধ্যমে জমির প্রকৃত ইতিহাস জানা সম্ভব হয় এবং ভবিষ্যৎ হয়রানি থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button