ভারতের কেরালায় মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবার হানা: ৬৯ জন আক্রান্ত, মৃত ১৯
Naegleria fowleri নামক এককোষী জীবটি উষ্ণ মিঠা পানিতে বাস করে এবং নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে ভয়াবহ সংক্রমণ ঘটায়। এই রোগের দ্রুত বিস্তার এবং উচ্চ মৃত্যুহার রাজ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: ভারতের কেরালা রাজ্যে ‘মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা’ নামে পরিচিত Naegleria fowleri (নাইগ্লেরিয়া ফাউলেরি)-এর সংক্রমণে সৃষ্ট প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিস (PAM) রোগে আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই বছর এখনও পর্যন্ত ৬৯ জনেরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এই পরিস্থিতিকে একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে দেখছে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করেছে।
কী এই মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবা?
Naegleria fowleri হলো একটি এককোষী অণুজীব বা অ্যামিবা, যা সাধারণত উষ্ণ মিঠা পানির উৎস, যেমন—হ্রদ, পুকুর, নদী এবং উষ্ণ প্রস্রবণে বাস করে। কাদামাটি বা জলাশয়ের তলদেশের পলিমাটিতে এরা ব্যাকটেরিয়া খেয়ে বেঁচে থাকে। এই অ্যামিবা সাধারণত মানুষের জন্য ক্ষতিকর না হলেও, যখন এর দ্বারা দূষিত পানি কোনোভাবে নাকের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে, তখন এটি মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
নাক দিয়ে প্রবেশের পর এই অ্যামিবা অলফ্যাক্টরি নার্ভ (ঘ্রাণশক্তি সংক্রান্ত স্নায়ু) ধরে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় এবং সেখানে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে মস্তিষ্কের কোষকলা ধ্বংস করতে শুরু করে। এর ফলে মস্তিষ্কে তীব্র প্রদাহ ও ফোলাভাব দেখা দেয়, যা প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিস (PAM) নামে পরিচিত।
সংক্রমণের লক্ষণগুলো কী কী?
এই রোগের লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের এক থেকে বারো দিনের মধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু করে এবং খুব দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটে। প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণ ভাইরাল মেনিনজাইটিসের মতো হওয়ায় রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব হতে পারে।
প্রাথমিক লক্ষণসমূহ:
- তীব্র মাথাব্যথা
- জ্বর
- বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া
পরবর্তী গুরুতর লক্ষণ:
- ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া
- বিভ্রান্তি ও মনোযোগের অভাব
- দেহের ভারসাম্য হারানো
- খিঁচুনি
- হ্যালুসিনেশন (অলীক কিছু দেখা বা শোনা)
লক্ষণ শুরু হওয়ার পর ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে রোগী কোমায় চলে যেতে পারে এবং মৃত্যু ঘটার আশঙ্কা থাকে। এই রোগের মৃত্যুহার ৯৭ শতাংশেরও বেশি, যা একে বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী সংক্রমণে পরিণত করেছে।
কেন এই সংক্রমণ এত চ্যালেঞ্জিং?
১. দ্রুত বিস্তার: অ্যামিবা মস্তিষ্কে পৌঁছানোর পর খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে, ফলে চিকিৎসা শুরু করার আগেই মস্তিষ্কের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়।
২. রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব: এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণ মেনিনজাইটিসের মতো হওয়ায় চিকিৎসকরা প্রায়শই ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের কথা ভাবেন। PAM-এর পরীক্ষা করতে দেরি হওয়ায় সঠিক চিকিৎসা শুরু করতে বিলম্ব হয়।
৩. কার্যকরী চিকিৎসার অভাব: যদিও কিছু অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক ওষুধ, যেমন Amphotericin B এবং Miltefosine ব্যবহার করে কিছু রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে, তবে এর কোনো প্রমাণিত নির্দিষ্ট চিকিৎসা এখনও নেই। বেঁচে ফেরার হার পুরোপুরি নির্ভর করে কতটা দ্রুত রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করা গেল তার ওপর।
কেরালার পরিস্থিতি ও সরকারের পদক্ষেপ
অতীতে কেরালায় এই রোগের সংক্রমণ সাধারণত কোনো একটি নির্দিষ্ট জলাশয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিক্ষিপ্তভাবে সংক্রমণের খবর আসছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বীণা জর্জ জানিয়েছেন যে, উন্নত রোগ নির্ণয় পদ্ধতির কারণে এখন বেশি কেস শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে, যা আগে সাধারণ এনসেফালাইটিস হিসেবে নথিভুক্ত হতো। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে:
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: পুকুর, হ্রদ বা নদীর মতো উষ্ণ ও স্থির পানিতে গোসল করার সময় সতর্কতা অবলম্বনের জন্য প্রচার চালানো হচ্ছে।
- জলাশয় জীবাণুমুক্তকরণ: রাজ্যের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কুয়া, পুকুর এবং অন্যান্য জলাশয়ে ক্লোরিনেশন ড্রাইভ চালানো হচ্ছে।
- সতর্কতামূলক বোর্ড: ঝুঁকিপূর্ণ জলাশয়ের পাশে সতর্কতামূলক বোর্ড লাগানো হচ্ছে।
কীভাবে সতর্ক থাকবেন?
এই মারাত্মক সংক্রমণ থেকে বাঁচতে কিছু সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি:
- নাক সুরক্ষিত রাখুন: উষ্ণ ও স্থির মিঠা পানিতে সাঁতার বা গোসল করার সময় নাকে ক্লিপ ব্যবহার করুন অথবা মাথা পানির উপরে রাখার চেষ্টা করুন।
- জলাশয়ের তলদেশ ঘাঁটবেন না: অ্যামিবা সাধারণত জলাশয়ের তলদেশের কাদামাটিতে থাকে, তাই পানিতে নামার সময় কাদা ঘাঁটা থেকে বিরত থাকুন।
- বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করুন: নাক পরিষ্কার করার জন্য (যেমন নেতি পট ব্যবহারের ক্ষেত্রে) কলের পানির পরিবর্তে ডিস্টিলড বা ফোটানো ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করুন।
- সন্দেহ হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: উষ্ণ মিঠা পানিতে গোসলের পর জ্বর, মাথাব্যথা বা বমির মতো লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে যান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ধরনের রোগের ঝুঁকি ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। তাই ব্যক্তিগত সতর্কতা এবং সম্মিলিত প্রতিরোধই এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান উপায়।



