অপরাধঅব্যাবস্থাপনাআইন, ও বিচারএক্সক্লুসিভগাজীপুরপ্রশাসনবাংলাদেশ

একাধিক মামলার ফেরারি আসামি খোকনের দাপট: জিম্মি টঙ্গীর দারাইলবাসী, পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী পশ্চিম থানার দারাইল এলাকায় একাধিক হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার ফেরারি আসামি মনোয়ার হোসেন খোকন (৪২) ও তার সহযোগীদের অত্যাচারে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভূমিদস্যুতা, মাদক ব্যবসা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে খোকন ও তার বাহিনী পুরো এলাকাকে জিম্মি করে রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একাধিক মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি হওয়া সত্ত্বেও তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।

খোকনের অপরাধের খতিয়ান

অনুসন্ধানে জানা যায়, সন্ত্রাসী খোকনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় গুরুতর অপরাধের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে:

  • টঙ্গী পশ্চিম থানায় ৬টি মামলা চলমান।
  • পল্টন থানায় বিস্ফোরক ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা রয়েছে (মামলা নং ২৫/৩৭৯, তারিখ: ১৪-০৯-২৪)।
  • উত্তরা পূর্ব থানায় দুটি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে একটি হত্যা মামলা (এফআইআর নং ৩, জিআর নং ১১৬, তারিখ: ২১ আগস্ট ২০২৪)।

লাইজু বেগম নামের এক নারীর দায়ের করা উত্তরা পূর্ব থানার হত্যা মামলায় খোকন প্রধান আসামি এবং বর্তমানে পলাতক। এ ছাড়া ভূমিদখল ও মারধরের অভিযোগে মামুন মিয়া শরাফতের দায়ের করা মামলায়ও তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি রয়েছে।

পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও মাসোহারার অভিযোগ

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি হওয়া সত্ত্বেও খোকন প্রায়ই এলাকায় প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করে, জমি দখল ও পরিমাপের কাজ চালায় এবং নিজ বাড়িতেই রাত্রিযাপন করে। বিষয়টি একাধিকবার টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জানানো হলেও কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, দারাইল পশ্চিমপাড়া বটতলা বস্তিতে খোকন ও তার সহযোগীরা মাদকের এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। টঙ্গীর সোনাভান বস্তির জাফর নামের এক পাইকারি বিক্রেতা তাদের মাদকের চালান সরবরাহ করে। এই অবৈধ कारोबार নির্বিঘ্নে চালাতে খোকনকে থানা পুলিশকে প্রতি মাসে লাখ টাকা মাসোহারা দিতে হয় বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, যার কারণে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারে বরাবরই উদাসীন থাকে।

রাজনৈতিক পরিচয় বদল ও অপকর্মের ঢাল

খোকন বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। গত সরকারের আমলে নিজেকে আওয়ামী যুবলীগের সক্রিয় সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে নানা অপকর্মে জড়িত ছিল। তার বিরুদ্ধে পল্টন থানার বিস্ফোরক ও হত্যা মামলাটি (ধারা: ১৪৩/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৩০২/২০১/৩৮৪/১১৪/১০৯/৩৪ পেনাল কোড ১৮৬০ এবং বিস্ফোরক আইন ১৯০৮-এর ৩/৬ ধারা) সে সময়ের।

সরকার পরিবর্তনের পর খোকন নিজেকে বাঁচাতে রাতারাতি বিএনপিতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করে এবং স্থানীয় নেতা হাসান সরকারের আশীর্বাদ পেতে এলাকায় পোস্টার ছাপিয়ে প্রচার চালায়। তবে তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও অতীত রেকর্ডের কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে তাকে দলে অনুপ্রবেশকারী ও আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয় এবং কোনো অঙ্গসংগঠনে তাকে অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগী পরিবারের হয়রানি ও প্রভাবশালী মহলের চাপ

খোকনের ভূমিদস্যুতার শিকার হয়েছেন মামুন মিয়া শরাফত নামের এক ব্যক্তি। প্রথমে মামুনের কাছ থেকে দেড় শতাংশ জায়গা কিনলেও পরে জাল দলিল তৈরি করে আরও অতিরিক্ত জমি জবরদখল করে নেয় খোকন। এই জাল দলিল তৈরিতে খোকনকে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি সাহায্য করে বলে জানা যায়। খোকন ও তার বাহিনী মামুনের পৈতৃক ভিটায় চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেয়াল তুলে দিয়েছে, যার ফলে তার পরিবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।

উল্টো হয়রানি করতে খোকনের ভাই আরিফ বাদী হয়ে মামুনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা (নং ২৬১/২৫) দায়ের করে, যা তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-তে পাঠানো হয়েছে। পিবিআই-এর তদন্তকারী কর্মকর্তা এনামুল হককে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি মামলার বিষয়টি স্বীকার করেন। খোকনের শ্যালক, বিগত সরকারের আমলে কর্মরত এএসপি সাইফুল ইসলাম, এই মামলায় তদবির করছেন বলে অভিযোগ উঠলে তিনি বিষয়টি মনে করতে পারছেন না বলে জানান।

পারিবারিক সিন্ডিকেট ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা

খোকন তার ভাই আরিফ, ভাতিজা সুমন, বোন জামাই নাজমুল এবং ভাগিনা সুন্দর আলীকে নিয়ে একটি পারিবারিক সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেটের মূল মদদদাতা হিসেবে কাজ করছেন সাবেক এএসপি সাইফুল ইসলাম, যিনি তার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে খোকন ও তার সহযোগীদের আইন থেকে বাঁচিয়ে রাখেন।

খোকনের অত্যাচারে এলাকার সাধারণ মানুষ ও ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় একাধিক সাংবাদিককেও হুমকি দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, খোকন ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং সুবিচার নিশ্চিত করতে ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button