
নিজস্ব প্রতিবেদক: সিলেট নগরীর শাহপরান থানা এলাকায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী খাদিমনগর চা বাগানের শত শত একর ভূমি দখলের অভিযোগ উঠেছে একটি প্রভাবশালী চক্রের বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন ধরে জাল দলিল ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এই চক্রটি বাগানের জমি দখল করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। এই দখলদার চক্রের নেতৃত্বে খোদ চা বাগানটির সাবেক দুর্নীতিবাজ ব্যবস্থাপক শামীম রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সাম্প্রতিক এক ঘটনায় গত ৩০ আগস্ট সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে এই চক্রের সদস্যরা বাগানের সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে বাগান কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে শাহপরান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।
থানায় দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়, সাবেক ম্যানেজার শামীমের নির্দেশনায় মিলাদ আহমদ, শুকুর আলী, প্রদীপ বুনাজী ও কানাই গোয়ালা নামে চার ব্যক্তি বাগানের সাইনবোর্ড উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে। এ সময় বাগানের প্রহরী জালু মিয়া তাদের বাধা দিলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করাসহ প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। বিষয়টি বর্তমান ব্যবস্থাপক আতিকুর রহমান আতিককে জানানো হলে তিনি বাগানের লিজগ্রহীতা আফজাল রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে তাঁর পরামর্শে আতিকুর রহমান বাদী হয়ে উল্লিখিত চারজনের নাম উল্লেখ করে শাহপরান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ১৫০০/২৫) দায়ের করেন।
অভিযুক্তরা হলেন—শাহপরান থানার মোহাম্মদপুর গ্রামের আলকাছ মিয়ার ছেলে মিলাদ আহমদ (২৭), একই গ্রামের মৃত রুহুল আমিনের ছেলে শুকুর আলী (৫০), গোয়ালগাঁও চামেলীবাগ গ্রামের মৃত পবিত্র বুনাজীর ছেলে প্রদীপ বুনাজী (৪১) এবং একই গ্রামের রাজকুমার গোয়ালার ছেলে কানাই গোয়ালা (৪৮)।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই চক্রের পাশাপাশি স্থানীয় একটি ক্লাবের নাম ব্যবহার করে মোহাম্মদপুরের আলেখ মিয়ার ছেলে সাদ্দামও বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করছে। সাদ্দাম সিসিকের সাবেক ৩৫ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। উল্লেখ্য, সাদ্দামের বিরুদ্ধে চলতি বছরেই ফারুক আহমদ নামে এক ব্যক্তি চাঁদাবাজির অভিযোগে একটি মামলা (শাহপরান থানার সিআর মামলা নং ৪২৪/২৪) দায়ের করেছিলেন।
দখলের নেপথ্যে দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্র:
খাদিমনগর চা বাগানের ভূমি দখলের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৮৫ সালের দিকে বাগানটির ব্যবস্থাপক হিসেবে শামীম কর্মরত থাকাকালীন প্রথম ভূমি লুটপাট শুরু হয়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে আঁতাত করে সরকারি খাসজমি যা চা বাগানের নামে লিজ দেওয়া হয়েছিল, তা জবরদখল করেন। পরবর্তীতে জাল দলিল ও ভুয়া সোলেনামা তৈরি করে এসব জমি সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা শুরু হয়। পাহাড়-টিলা কেটে অবৈধভাবে প্লট তৈরি করে এবং বাগানের উপজাতি শ্রমিকদের মালিক সাজিয়ে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে জমি বিক্রি করে এই চক্রটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
সাবেক ম্যানেজার শামীমের মদদেই ইসলামপুর, মেজরটিলা, টেক্সটাইল রোড, সৈয়দপুর, আলুরতল, বাগমারা, জাহানপুর, চামেলীবাগ, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর ও ফাতেমা নগরসহ বিভিন্ন নামে অবৈধ বসতি গড়ে তুলে বাগানের বিশাল এলাকা দখল করা হয়েছে।
আইনি প্রেক্ষাপট ও বর্তমান পরিস্থিতি:
সিলেট সদর উপজেলার বহর, খাদিমনগর ও দেবপুর মৌজার সরকারি খাসজমি পাকিস্তান আমলে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে সরকার প্রথমে খাদিম টি গার্ডেনের নামে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মামুনুর রশীদ চৌধুরীর নামে জমি বন্দোবস্ত দেয়। পূর্ববর্তী লিজের মেয়াদ শেষ হলে ২০১২ সালে নিনা আফজাল রশীদ চৌধুরীর নামে পুনরায় ২০২২ সাল পর্যন্ত লিজ প্রদান করা হয়। নতুন লিজগ্রহীতা দায়িত্ব নেওয়ার পর সাবেক ম্যানেজার শামীমকে অব্যাহতি দিয়ে আতিকুর রহমানকে নতুন ব্যবস্থাপক নিয়োগ দেওয়া হয়।
তবে ব্যবস্থাপক পরিবর্তন হলেও ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্য কমেনি। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক ম্যানেজার শামীম, চৌকিদার ছাত্তার, প্রদীপ, নিখিল মোড়া, বীরবল মোড়া, শুকুর আলী, মিন্টু মোড়া, চিটু মোড়া, কুরেশ মোড়া, মিল্লাত এবং মাদক ব্যবসায়ী পারভেজ ও রিয়াজসহ একটি বিশাল সিন্ডিকেট এখনো দখল বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সরকার পরিবর্তনের পর দখলকারীরা এখন রাজনৈতিক পরিচয় বদল করে বিএনপি নাম ব্যবহার করে তাদের অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে বলে স্থানীয়রা জানান।
বাগান কর্তৃপক্ষ দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। লিজগ্রহীতা আফজাল রশীদ চৌধুরী বাগানের সীমানা নিয়ন্ত্রণ এবং অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যবস্থাপক ও কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। শাহপরান থানায় অভিযোগ দায়েরের পর পুলিশ এখনো কাউকে আটক করতে পারেনি।



