আধুনিক ফ্ল্যাটে বাবা-মায়ের একাকীত্ব: নীরব সামাজিক অবক্ষয়

ডেস্ক রিপোর্ট: আধুনিকতার ছোঁয়া লাগা শহুরে ফ্ল্যাটগুলো যেন অনেক ক্ষেত্রেই প্রবীণ বাবা-মায়ের জন্য হয়ে উঠছে একাকীত্বের আশ্রয়স্থল। একসময় যারা সন্তানদের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করেছেন, সেই বাবা-মায়েরাই আজ নিজেদের ঘরে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, যা সমাজে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
ইসলামী ধর্মমতে, পিতা-মাতার প্রতি সদাচারী হওয়া সন্তানের জন্য অপরিহার্য। পবিত্র কুরআনের সূরা আল-ইসরা’র ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা কেবল তাঁর ইবাদত করার পাশাপাশি পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষভাবে তাদের বার্ধক্যে ‘উফ’ শব্দটিও উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং সম্মানজনক কথা বলতে বলা হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা ও বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, একবিংশ শতাব্দীর শহুরে জীবনে অনেক আধুনিক ফ্ল্যাটের ভেতরেই জন্ম নিচ্ছে এক ভয়ংকর নীরবতা। সন্তানদের জন্য সারা জীবন পরিশ্রম করা বাবা-মায়েরা আজ নিজেদের ঘরেই যেন অদৃশ্য অতিথিতে পরিণত হয়েছেন।
এক নির্মম বাস্তবতা:
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সন্তানদের হাতে বাবা-মায়ের পেনশনের টাকা চলে যাচ্ছে। নিজেদের ফ্ল্যাটে তারা ভাড়াটের মতো জীবনযাপন করছেন, এমনকি অতিথিদের জন্য তাদের ঘর বদলে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। পিতা-মাতার কথা বলাকে বিরক্তি হিসেবে দেখা এবং নীরব থাকলে অভিযোগ তোলার মতো বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন তারা। এই ধরনের আচরণ ইসলামী মূল্যবোধ ও মানবিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) পিতা-মাতার প্রতি অবহেলার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “পিতা-মাতা যার জীবদ্দশায় বুড়ো বয়সে উপনীত হয়েছে, অথচ সে জান্নাত লাভ করতে পারল না – তার নাক ধুলায় গুঁড়ো হোক।” (সহিহ মুসলিম)
ধর্মীয় বিশ্লেষকরা মনে করেন, যারা বাবা-মায়ের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাদের বোঝা মনে করছেন, তারা মূলত নিজেদের পরকাল ধ্বংস করছেন। যে সন্তান তার জন্মদাতার চোখের জলকে অবহেলা করে, তারা শুধু অমানুষ নয়, নিজেদের ঘরে আল্লাহর গজবও ডেকে আনছেন।
দায়িত্ব শুধু সামাজিক মাধ্যমে নয়:
বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করিয়ে দেন যে, শুধুমাত্র ‘মাদার্স ডে’ বা ‘ফাদার্স ডে’-তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করে সন্তানের দায়িত্ব শেষ হয় না। বরং বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারলে এবং তাদের চোখের পানি আটকাতে পারলেই একজন সন্তান প্রকৃত সুপুত্র বা সুকন্যা হিসেবে বিবেচিত হন।
আজ যারা নিজেদের বাবা-মায়ের সঙ্গে এমন আচরণ করছেন, ভবিষ্যতে তাদের সন্তানদের কাছ থেকেও একই ধরনের ব্যবহার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই পিতা-মাতার প্রতি সম্মানজনক ব্যবহার, তাদের অর্থ, সম্পত্তি ও ইজ্জতের হক রক্ষা এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের পাশে থাকা অত্যাবশ্যক। নিজেদের জন্য জান্নাতের দরজা খুলবে, নাকি নীরব নরক তৈরি হবে — এই সিদ্ধান্ত আজ প্রতিটি সন্তানের হাতে।



