কেন দূরে সরছে তরুণরা ইসলাম বিমুখতার গভীর বিশ্লেষণ

ইসালামিক ডেস্ক: বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশের মধ্যে ইসলামের প্রতি উদাসীনতা এবং ধর্মবিমুখতা লক্ষ্য করা যায়, যা মুসলিম সমাজের জন্য একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। কেন তরুণরা ইসলামের সঠিক পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? এর নেপথ্যে রয়েছে বহুবিধ ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ। এই প্রতিবেদনে কুরআন, হাদিস এবং সালাফদের (পূর্ববর্তী মনীষী) প্রজ্ঞাপূর্ণ উক্তির আলোকে এর মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করা হলো।
১. আত্মিক অবক্ষয় এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ
তরুণদের ইসলাম থেকে বিচ্যুতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো তাদের অন্তরের রোগ। এই রোগ দুই প্রকার: শাহওয়াত (অবৈধ কামনা-বাসনা) এবং শুবুহাত (ইসলাম বিষয়ক সন্দেহ)। পার্থিব ভোগবিলাস, খ্যাতি, অর্থ এবং ফ্যাশনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ তাদের আত্মাকে কলুষিত করছে। অন্যদিকে, ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন ভুল ধারণা, নাস্তিক্যবাদ এবং পশ্চিমা দর্শনের প্রভাবে তাদের মনে নানা সন্দেহের জন্ম নিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, আর আল্লাহ তাদের রোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।” (সূরা আল-বাকারা, ২:১০)
২. পার্থিব জীবনের মোহ ও পরকালবিমুখতা
আধুনিক তরুণ সমাজ দুনিয়ার জীবনকেই সবকিছু মনে করছে। ফলে তারা আখিরাত বা পরকালের জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়েছে। এই গাফেলতির বিষয়ে আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেন:
“তাদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দিন, তারা খেতে থাকুক, ভোগ করতে থাকুক এবং মিথ্যা আশা তাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখুক, অচিরেই তারা তাদের পরিণাম জানতে পারবে।” (সূরা আল-হিজর, ১৫:৩)
৩. অসৎ সঙ্গ এবং প্রতিকূল পরিবেশ
তরুণদের জীবনে বন্ধু এবং পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব অত্যন্ত গভীর। একজন মানুষ তার বন্ধুদের দ্বারাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“মানুষ (কিয়ামতের দিন) তার সাথেই থাকবে, যাকে সে ভালোবাসে।” (সহীহ বুখারী: ৬১৭০, সহীহ মুসলিম: ২৬৪১)যখন তরুণরা ইসলামবিমুখ, অশ্লীলতায় লিপ্ত এবং বস্তুবাদী বন্ধুদের সাথে মেশে, তখন তাদের মধ্যেও সেই প্রভাব পড়ে, যা তাদেরকে দ্বীন থেকে দূরে ঠেলে দেয়।
৪. বিদআত ও কুসংস্কারের প্রভাব
অনেক তরুণ ইসলামকে সঠিকভাবে জানার সুযোগ পায় না। তারা তাদের পরিবার বা সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন বিদআত (ধর্মের নামে নতুন উদ্ভাবন) এবং কুসংস্কারকেই আসল ইসলাম ভেবে বড় হয়। ফলে খাঁটি ইসলামের শিক্ষা তাদের কাছে পৌঁছায় না। এ কারণেই প্রখ্যাত তাবেয়ী, ইমাম ইবনু সীরীন (রহ.) বলেছেন:
“নিঃসন্দেহে এই জ্ঞানই হলো দ্বীন। সুতরাং, তোমরা কার কাছ থেকে তোমাদের দ্বীন গ্রহণ করছ, তা ভালোভাবে দেখে নাও।” (সহীহ মুসলিমের ভূমিকা)
৫. গণমাধ্যম ও পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন
আধুনিক মিডিয়া, যেমন—সিনেমা, সঙ্গীত এবং সোশ্যাল মিডিয়া তরুণদের মন ও মননকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। এসব মাধ্যমে ইসলামকে প্রায়শই একটি পশ্চাৎপদ জীবনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, অন্যদিকে পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতিকে আকর্ষণীয় ও আধুনিক হিসেবে তুলে ধরা হয়। এর ফলে তরুণদের মনে ইসলামের প্রতি এক ধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হয়।
সালাফদের দৃষ্টিতে বিচ্যুতির কারণ
পূর্ববর্তী ইসলামিক মনীষীগণ বহু আগেই এ সকল সমস্যার ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন। তাদের কিছু মূল্যবান উক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য:
- আল-ফুদাইল ইবনু ‘ইয়াদ (রহ.) বলেছেন: “যখন দুনিয়া কোনো বান্দার অন্তরকে গ্রাস করে ফেলে, তখন সেখানে আখিরাতের জন্য আর কোনো স্থান অবশিষ্ট থাকে না।” (হিলইয়াতুল আউলিয়া, ৮/৯১)
- হাসান আল-বসরী (রহ.) বলেন: “আমি এমন কাউকে দেখিনি, যে মৃত্যুকে স্মরণ করে আনন্দিত হতে পারে।” (আয-যুহদ, ইমাম আহমাদ: ২৪০)। এটি ইঙ্গিত করে যে, তরুণরা মৃত্যুকে ভুলে থাকার কারণেই আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়।
- ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন: “দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করাই হলো সকল লাঞ্ছনা ও অপমানের মূল।” (আল-জাওয়াবুল কাফী, ১/৫)
- আল-আউযাঈ (রহ.) জ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন: “যখন (সঠিক) জ্ঞান বিদায় নেয়, তখন ইসলামের কোনো সম্মানই আর বাকি থাকে না।” (জামি‘ বায়ানিল ‘ইলম, ১/১৮৭)
উপসংহার:
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, তরুণ সমাজের ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার পেছনে হৃদয়ের রোগ, দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি, অসৎ সঙ্গ, ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব এবং মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব মূল ভূমিকা পালন করছে। সালাফদের দেখানো পথ অনুসরণ করে—পার্থিব মোহ ত্যাগ, মৃত্যুকে স্মরণ এবং সঠিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই তরুণ প্রজন্মকে পুনরায় ইসলামের পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।



