পরকীয়ার চোরাবালি: এক বিশ্বাসভঙ্গের উপাখ্যান
অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: অন্যের স্বামীর শরীরের প্রতি আকর্ষণ বা অন্যের স্ত্রীর উষ্ণ সান্নিধ্যের নেশা কতটা তীব্র হতে পারে? কতটা ভয়ংকর সেই প্রলোভন, যার জন্য একজন মানুষ তার নিজের বিশ্বস্ততার সাজানো ঘরকে জেনেশুনে আগুনে ঠেলে দেয়? পরকীয়া—এই নিষিদ্ধ জগতের চাকচিক্য আর উত্তেজনা বাইরে থেকে আমাদের প্রলুব্ধ করে, কিন্তু এর ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা যায় কেবল অন্ধকার, প্রতারণা আর আত্মার অবক্ষয়।
যাকে সমাজ ‘পরকীয়া’ বলে, তাকে ‘চরিত্রের ক্যানসার’ বললে অত্যুক্তি হয় না। এই অবক্ষয়ের জন্য সমাজ প্রায়শই তৃতীয় কোনো ব্যক্তির দিকে আঙুল তোলে। ‘মেয়েটা ডাইনি, ঘর-ভাঙানি’ অথবা ‘ছেলেটা সুযোগসন্ধানী’—এরকম সহজলভ্য অপবাদ দিয়ে মূল সমস্যাকে পাশ কাটানো হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, সেই দরজা বাইরের একজন মানুষ খুলল কীভাবে? চোর তখনই ঘরে প্রবেশ করে, যখন ঘরের মালিক নিজেই দরজা খুলে দেয়। পরকীয়ার খেলায় তৃতীয় ব্যক্তিটি হয়তো সেই চোর, কিন্তু আসল বিশ্বাসঘাতক তো সে, যে নিজের ঘরের দরজা অন্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।
প্রতারকের আসল পরিচয়
ভেবে দেখুন তো, যে পুরুষ নিজের সন্তানের মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে, তার স্ত্রীর বিশ্বাসকে নির্মমভাবে পদদলিত করে রাতের অন্ধকারে আপনার কাছে শারীরিক উত্তাপের খোঁজে ছুটে আসে, সে কি সত্যিই আপনার ‘রাজকুমার’? যে নারী তার স্বামীর প্রতি দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করে আপনার বুকে আশ্রয় খোঁজেন, তিনি কি আসলেই একজন ‘নির্যাতিতা রাজকন্যা’?
না, এটি কোনো রূপকথা নয়, বরং এক কদর্য বাস্তবতা। আপনি যাকে আপনার জীবনের নায়ক বা নায়িকা ভাবছেন, সে আসলে তার নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় খলনায়ক। যে নিজের জীবনসঙ্গীকে দিনের পর দিন ঠকাতে পারে, সে একজন প্রতারক ছাড়া আর কিছুই নয়। একটি কঠিন সত্য মনে গেঁথে নিন: “যে পুরুষ নিজের স্ত্রীকে ঠকায়, বা যে নারী তার স্বামীকে ঠকায়, সে আপনাকেও ঠকাবে।” এটি কোনো অভিশাপ নয়, এটাই তার চরিত্র। তার রক্তে যদি বেইমানি মিশে থাকে, তবে আজ সে সঙ্গীর সাথে যা করছে, কাল পরিস্থিতি বদলালে আপনার সাথেও ঠিক তাই করবে। কারণ সে ভালোবাসতে জানে না, সে কেবল নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে জানে।
দায়িত্বহীন সম্পর্কের ছাড়পত্র?
এই সম্পর্কের আসল উদ্দেশ্য কী? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, পরকীয়া হলো কোনো প্রকার দায়িত্ব বা প্রতিশ্রুতি ছাড়াই শারীরিক ও মানসিক চাহিদা পূরণের একটি সহজ উপায়। নিজের জীবনসঙ্গী হয়তো পুরনো হয়ে গেছে, সম্পর্কে এখন আর নতুনত্ব নেই, তাই বাইরে একটু উত্তেজনা খুঁজতে ক্ষতি কী—এই ভাবনা থেকেই এর শুরু। এই মানুষগুলো আপনাকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখাবে, কিন্তু কখনোই আপনাকে স্ত্রীর বা স্বামীর সামাজিক মর্যাদা দিতে চাইবে না।
কারণ সংসার করার জন্য যে দায়িত্ব ও স্বীকৃতি প্রয়োজন, তা তার ঘরেই সুরক্ষিত আছে। আপনি তার জীবনে কেবল একটি সাময়িক উত্তেজনা বা ‘প্রজেক্ট’, যার সাথে কোনো দায়বদ্ধতার সম্পর্ক নেই। যখনই আপনি এই সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য চাপ দেবেন, দেখবেন আপনার সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি গিরগিটির মতো রং বদলাচ্ছে। কারণ তার উদ্দেশ্য আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া নয়, কেবল ভোগ করা।
দোষের ভাগীদার কে?
এই লেখাটি পড়ার পর আপনার মনে হতে পারে, তাহলে আপনার দোষ কোথায়? হ্যাঁ, আপনারও দোষ আছে। আপনার দোষ, আপনি একটি মিথ্যাকে জেনেবুঝে বিশ্বাস করেছেন। আপনি এমন একজনের হাত ধরেছেন, যার হাত ইতিমধ্যেই বিশ্বাসের রক্তে রঞ্জিত। আপনি অন্যের সাজানো সংসারে আগুন লাগিয়ে সেই উত্তাপে নিজের সুখ খুঁজতে চেয়েছেন।
সমাজ হয়তো কেবল তৃতীয় ব্যক্তিকেই দোষারোপ করবে, কারণ সেটাই সবচেয়ে সহজ। কিন্তু সত্য হলো, এই পাপের ভাগীদার তিনজনই। প্রথম ও প্রধান দোষী সেই প্রতারক পুরুষ বা নারী, যে নিজের সঙ্গীকে ঠকিয়েছে। দ্বিতীয় দোষী আপনি, কারণ আপনি জেনে শুনে সেই পাপে নিজেকে জড়িয়েছেন। আর তৃতীয়ত, আমাদের সমাজও দায়ী, যা সম্পর্কের ভেতরের মানসিক দূরত্ব বা সমস্যার সমাধান না খুঁজে, কেবল বাহ্যিক দোষারোপের খেলায় মেতে থাকে।
আজ আপনি যার জন্য নিজের সম্মান, সময় ও আবেগ নষ্ট করছেন, কাল যখন সে আপনাকে ছেড়ে তার ‘নিরাপদ’ সংসারে ফিরে যাবে, তখন আপনার পাশে কে থাকবে? সমাজ আপনাকে ‘নষ্টা’ বা ‘চরিত্রহীন’ বলে গালি দেবে, আর সেই প্রতারক মানুষটি নিজের পরিবারে ফিরে গিয়ে একজন ‘ভালো স্বামী’ বা ‘ভালো স্ত্রী’ সাজার অভিনয় করবে। খেলা শেষে আপনি রয়ে যাবেন একা, একজন পরাজিত সৈনিক হিসেবে।
তাই আবারও ভাবুন। অন্যের এঁটো প্লেটে খাওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। অন্যের ভেঙে যাওয়া বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে নিজের সুখের প্রাসাদ গড়া যায় না। যে মানুষটা তার নিজের বিশ্বস্ততার দাম দিতে জানে না, সে কখনোই আপনার হতে পারে না। আজ অন্যের ঘর ভাঙার আগুনে যে উত্তাপ নিচ্ছেন, কাল সেই আগুনেই আপনার নিজের সাজানো স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যাবে না তো? উত্তরটা আপনার বিবেকের কাছেই আছে।



