সন্ত্রাসী অস্ত্রের আস্তানা জঙ্গল সলিমপুরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০

নিজস্ব প্রতিবেদ আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া রোকন-ইয়াছিন# আহত ২ জনের অবস্থা আশংকাজনক# হামলা শুরু হয় রাত আড়াইটা থেকেচট্টগ্রাম জেলা সীতাকুণ্ড উপজেলার ১০নং সলিমপুর ইউনিয়নের জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল ও পার্শ্ববর্তী আলী নগরে পাহাড়ি এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে দুই গ্রুপের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে কাল্লু নামে ২৮ বছরের এক যুবক নিহত হয়েছে। একই ঘটনায় আহত হয়েছেন উভয় গ্রুপের কমপক্ষে ২০ জন। হামলার সময় নিহত ও আহতরা বেশিরভাগ চাপাতির কোপে ও গুলিবিদ্ধ বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়। আহতদের মধ্যে আরো দুইজন আশঙ্কাজনক অবস্থান রয়েছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘসময় ধরে ছিন্নমূল ও আলী নগরে সরকারি পাহাড় দখল করে কেটে প্লট বানিয়ে বেচা-বিক্রিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আছে ইয়াছিন। অন্যদিকে ৫ আগস্টের পর থেকেই একই এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে বেশ সক্রিয় সলিমপুর ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রোকন উদ্দিন মেম্বার। পাহাড়ে প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে ৬০ লাখ টাকার অস্ত্র কেনার স্বীকারোক্তিমূলক রোকনের একটি অডিও ইতোমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে। মূলত আলীনগরে ও ছিন্নমূলে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখা ও বিস্তারে রাত আড়াইটার দিকে দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে রোকন গ্রুপ। তাদের ঠেকাতে পাল্টা হামলা করে ইয়াছিন গ্রুপ। হামলার সময় ছিন্নমূল ও আলী নগরের বেশকিছু বাড়িঘর কুপিয়ে নষ্ট করা হয়। দোকানপাটে লুটপাট চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। এসময় উভয়গ্রুপের অন্তত ৪০ জন হামলাকারীদের হাতে জিম্মি হয়েছেন। ইয়াছিন গ্রুপ রোকন গ্রুপের ১৫ জনের মতো এবং রোকন গ্রুপ ইয়াছিন গ্রুপের ২৫ জনের মতো জিম্মি করে নিয়ে যায় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার রাত ১০টা থেকে রোকন মেম্বারের অনুসারীরা আকবরশাহ এলাকার বড় গ্যাসলাইন সংলগ্ন মাঠ, ফকিরহাট ও জলিল এলাকায় জড়ো হতে থাকেন। আকবরশাহ এলাকা থেকে হামলায় অংশ নেয় রোকনের অনুসারি নলা কাশেম, ডিস খোকন, আরিফ ও বেলালের নেতৃত্বে শতাধিক ব্যক্তি। একইভাবে ফকিরহাট ও জলিল এবং সলিমপুর ইউনিয়নে রোকনের একাধিক অনুসারির নেতৃত্বে প্রায় হাজারখানেক ব্যক্তি হামলায় অংশ নেয়। পাল্টা হামলায় অংশ নেয় ইয়াছিন গ্রুপের ৫ শতাধিক নারী-পুরুষ। গতকাল শনিবার দুপুরের পর সীতাকুণ্ড মডেল থানা ও ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বরত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আহতদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। নিহত কাল্লুর নাম পাওয়া গেলেও তার বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি।আহত গুলিবিদ্ধরা হলেন হাটহাজারী উপজেলার পশ্চিম কোয়াইশের মাহবুবের ছেলে বায়েজিদে বসবাসরত জাবেদ প্রকাশ ভাগিনা জাবেদ (৩৮), সলিমপুর ইউনিয়নের লতিফপুর এলাকার মৃত আশরাফ উল্ল্যার ছেলে মো. জাকির (৪৮), বায়েজিদ এলাকার গণি মিয়া সওদাগরের ছেলে মো. তানভীর হোসেন (২৩), আরেফিন নগরের মৃত কফিলুদ্দিনের ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৪৩), জঙ্গল সলিমপুরের ছিন্নমূল এলাকার ৩নং সমাজের মৃত মজিবুল হকের ছেলে ফজলুল করিম (৩২), নগরীর বায়েজিদ থানার রুবি গেইট রশিদ কলোনির মৃত রুহুল আমিনের ছেলে ইসমাইল হোসেন বাবু (৩০), বায়েজিদ থানার বাংলাবাজার ডেবারপার এলাকার ফরিদের ছেলে জাহিদুল ইসলাম (১৯), বায়েজিদ শেরশাহ বাংলাবাজারের প্রকাশ বড়ুয়ার ছেলে সৌরভ বড়ুয়া (১৭), একই এলাকার সেলিমের ছেলে মো. পারভেজ (২০), নগরীর পতেঙ্গা চরপাড়া এলাকার মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে মো. নুরুল আলম (৪০), বায়েজিদ থানার খোকন মিয়ার ছেলে শুক্কুর আলম (২২), বায়েজিদ সিরাজ কলোনী আমিনুর রহমানের ছেলে মো. রায়হান (১৮), আকবরশাহ থানার লতিফপুর এলাকার হুমায়ুন কবিরের ছেলে মো. শামীম (২৯), সীতাকুণ্ড পৌর সদরের মাহমুদাবাদ চৌধুরীপাড়ার চাঁন মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ হারুন (৪৫), মাসুদ (৩৫) ও এমদাদুল হক (৪৭)। বাকিদের নাম পরিচয় জানা যায়নি।জানা যায়, সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যখ্যাত জঙ্গল ছলিমপুর দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসীদের আস্তানা হিসেবে পরিচিত ছিল। ছলিমপুর ও আলীনগর এলাকাটি পুরোপুরি পাহাড়-টিলা-খাল-ছড়াবেষ্টিত। জেলা প্রশাসন তথা সরকারি মালিকানাধীন এসব পাহাড়-টিলা দখল করে তা কেটে প্লট বানিয়ে অবৈধ বাণিজ্যে যুক্ত বড় একটি চক্র। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারের কতিপয় নেতাদের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রিত হয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকে এখন পর্যন্ত এর নিয়ন্ত্রণ সন্ত্রাসী ইয়াছিনের হাতে। অন্যদিকে ছলিমপুর ইউপির সাবেক মেম্বার ও যুবদল নেতা রোকন উদ্দিন মেম্বার সেখানে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বেশ সক্রিয়। তিনি লায়ন আসলাম চৌধুরীর অনুসারি হিসেবে পরিচিত। বিগত সময়ে ছিন্নমূল ও আলীনগরে ব্যাপকভাবে পাহাড়-টিলা কেটে সাবাড় করার কারণে সরকার বড় ধরণের অভিযান চালিয়ে সেটি নিয়ন্ত্রণে নিলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আবারও সেটি বেদখলে চলে যায়। ৫ আগস্টের পর থেকে একাধিক স্কেভেটর ব্যবহার করে বেশ কয়েকটি পাহাড় কেটে সাবাড় করে ইয়াছিন বাহিনী। সেখানে বসতি স্থাপন করে প্লট বিক্রি, বিদ্যুৎ ও পানির অবৈধ সংযোগের ব্যবসা করে আসছে ইয়াছিন। মূলত এসব নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে রোকন মেম্বার তার অনুসারিদের মাধ্যমে বেশ সক্রিয়। বিভিন্ন অপরাধী চক্রকে ব্যবহার করে জঙ্গল ছলিমপুর, ছিন্নমূল, আলীনগর এলাকাগুলো আবারও অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। শুরু হয় আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। একসময় জঙ্গল ছলিমপুর ছিন্নমূল নিয়ন্ত্রণ করতো রোকন গ্রুপ। আর আরেফিন নগর-আলীনগর নিয়ন্ত্রণ করতো ইয়াছিন গ্রুপ। এদিকে এসব বিষয়ে জানতে রোকন গ্রুপের রোকনউদ্দিন মেম্বারকে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। একইভাবে ইয়াছিন গ্রুপের আলিনগরের ইয়াছিনকে ফোন দিলেও তিনিও ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সোহেল রানা বলেন, ‘জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল আলীনগরে রোকন মেম্বার গ্রুপ ও ইয়াসিন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের বিষয়টি শুনে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। সেখান থেকে চাপাতির কোপে আহত অবস্থায় ১৫ জনের মত লোকজনকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে প্রেরণ করি। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক একজনকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে আহতদের মধ্যে আরও দু’জনের মত আশঙ্কাজনক অবস্থা রয়েছেন’।



