ইসলামী শরীয়া আইন: একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার রূপরেখা
ধর্মীয় ডেস্ক: “শরীয়া আইন” শব্দটি প্রায়শই আলোচনায় এলেও এর প্রকৃত অর্থ ও পরিধি সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা সীমিত। এটি কেবল অপরাধ ও শাস্তির বিধান নয়, বরং ইসলাম ধর্মের এক বিস্তৃত আইনি ও নৈতিক কাঠামো, যা একজন মুসলমানের জীবনের প্রতিটি দিককে পথনির্দেশনা দেওয়ার জন্য প্রণীত হয়েছে।
শরীয়া আইনের মূল ভিত্তি ও পরিধি
শরীয়া আইনের ভিত্তি হলো দুটি প্রধান ঐশ্বরিক উৎস: পবিত্র কুরআন এবং সুন্নাহ (নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কথা, কাজ ও সম্মতি)। এই দুটি উৎসের ওপর ভিত্তি করে শরীয়া আইন মানুষের আধ্যাত্মিক, মানসিক এবং শারীরিক—সকল প্রকার আচরণের নীতি নির্ধারণ করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর আদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি ন্যায়নিষ্ঠ ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে মানুষকে সহায়তা করা। এর পরিধি ব্যক্তিগত ইবাদত থেকে শুরু করে পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক আচার, ব্যবসায়িক লেনদেন এবং রাষ্ট্রীয় শাসন পর্যন্ত বিস্তৃত।
কর্মকাণ্ডের নৈতিক শ্রেণীবিন্যাস
ইসলামী আইনশাস্ত্রের একটি মৌলিক দিক হলো, এটি মানবজীবনের সমস্ত কাজকে নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে পাঁচটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করে। এগুলো হলো:
- ফরজ/ওয়াজিব (বাধ্যতামূলক): এমন কাজ যা পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। যেমন—দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা।
- মানদুব/মুস্তাহাব (সুপারিশকৃত): এমন কাজ যা করলে সওয়াব বা পুণ্য লাভ হয়, তবে না করলে কোনো গুনাহ নেই। যেমন—নফল রোজা রাখা।
- মুবাহ (অনুমোদিত): এমন কাজ যা করা বা না করা ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এর জন্য কোনো পুরস্কার বা শাস্তি নেই।
- মাকরুহ (নিরুৎসাহিত): এমন কাজ যা করা অনুচিত বা অপছন্দনীয়, তবে এটি হারাম বা নিষিদ্ধ নয় এবং এর জন্য কোনো শাস্তি নেই।
- হারাম (নিষিদ্ধ): এমন কাজ যা করা কঠোরভাবে নিষেধ এবং এর জন্য শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। যেমন—সুদ গ্রহণ করা বা মদ্যপান করা।
শরীয়া এবং ফিকহ্-এর পার্থক্য
শরীয়া এবং ফিকহ্-এর মধ্যে পার্থক্য বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। শরীয়া বলতে সেই অপরিবর্তনীয় ঐশ্বরিক আইনকে বোঝানো হয়, যা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সরাসরি প্রাপ্ত। অন্যদিকে, ফিকহ্ হলো ইসলামী আইনবিদ বা পণ্ডিতদের দ্বারা শরীয়ার সেই মূলনীতিগুলোর ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ এবং প্রায়োগিক সিদ্ধান্ত। ফিকহ্ হলো শরীয়ার উপর ভিত্তি করে মানবীয় উপলব্ধি ও গবেষণার ফসল।
আধুনিক বিশ্বে শরীয়ার প্রয়োগ
বর্তমান বিশ্বে শরীয়া আইনের প্রয়োগ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে দেখা যায়। সৌদি আরব, ইরানসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশে শরীয়া আইন রাষ্ট্রীয় আইনের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। আবার অনেক দেশে পারিবারিক বিষয়, যেমন—বিয়ে, তালাক ও উত্তরাধিকার নির্ধারণে শরীয়া আইন ব্যবহৃত হয়।
এছাড়াও, বিশ্বজুড়ে ইসলামী অর্থব্যবস্থায় (Islamic Finance) শরীয়ার প্রয়োগ ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়, যেখানে সুদের (রিবা) নিষেধাজ্ঞা এবং হালাল বিনিয়োগের মতো নীতিগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়।
সর্বোপরি, শরীয়া আইনকে কেবল একটি দণ্ডবিধি হিসেবে দেখলে এর মূল উদ্দেশ্য অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এটি মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য একটি নৈতিক ও আইনি পথনির্দেশিকা।



