শহীদ জনির শেষযাত্রা: এক বাবার অন্তহীন অপেক্ষার গল্প

বিশেষ প্রতিবেদক: “সারাজীবন কানলেও কি এই শোক শেষ হইব?”— পুত্রশোকে কাতর এক বাবার এই আর্তনাদ যেন কোনোভাবেই থামছে না। কথাগুলো বলছিলেন জুলাইয়ের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে শহীদ জনি হোসেনের বাবা মনির হোসেন। যে ছেলে ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা, মাত্র ২৪ বছর বয়সেই সংসারের হাল ধরেছিল, সেই ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে তিনি আজ প্রায় শয্যাশায়ী।
সেই ভয়াল দিনের স্মৃতি
গত ২০ জুলাই, যাত্রাবাড়ীর রাজপথ যখন ছাত্র-জনতার স্লোগানে উত্তাল, তখন তাদেরই একজন হয়ে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন জনি হোসেন। বাবাকে চা খেতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য ছিল স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে শরিক হওয়া। কে জানত, সেটাই হবে তার শেষ যাত্রা!
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ এবং পরিবারের কাছ থেকে জানা যায়, আন্দোলন চলাকালে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া একটি গুলি জনির কোমরের এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়েও অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দেন তিনি। নিজের শার্ট খুলে কোমরের ক্ষতস্থানে বেঁধে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা করেন, একাই একটি রিকশা ডেকে হাসপাতালের দিকে যেতে বলেন। কিন্তু হাসপাতালের পথেই সব শেষ হয়ে যায়। রিকশাচালক মাঝপথে পেছনে ফিরে দেখেন, জনি রিকশার একপাশে হেলে পড়েছেন, নিথর।
গুমের চেষ্টা ও লাশ উদ্ধার
জনির বাবা মনির হোসেনের জন্য এরপর শুরু হয় আরও এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। তিনি জানান, পুলিশের নিরাপত্তায় ২৫-৩০ জন শহীদের লাশবাহী একটি গাড়ি গুমের উদ্দেশ্যে চিটাগাং রোডের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু সেখানকার ছাত্র-জনতা সাহসিকতার সঙ্গে পুলিশের কাছ থেকে সেই গাড়িটি ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। লাশের স্তূপের মধ্য থেকেই খুঁজে পাওয়া যায় জনিকে।
সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে মনির হোসেনের গলা ভারি হয়ে আসে। তিনি বলেন, “লাশগুলো একটার ওপর একটা পইড়া ছিল! ওইখানেই আমার পোলারে পাইলাম, কোমরের একপাশ থেইকা গড়গড়ায়া রক্ত পড়তাছে!”
বাবার না শেষ হওয়া কান্না
সেইদিনের পর থেকে মনির হোসেনের জীবনে পুত্রশোক এক স্থায়ী ক্ষত হয়ে রয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, অপারেশন করাতে হয়েছে। শোকে স্ট্রোক করে এখন তিনি প্রায় ঘরবন্দী।
কথা বলার সময়ও তার চোখ ভিজে উঠছিল। তিনি বলেন, “কান্দুম না? আমার ২৪ বছর বয়সী জোয়ান পোলা! বেকারির সামনে গেলে মনে হয় পোলায় বিস্কুট খাইতাছে, টংয়ের সামনে দেখি সিগারেট নিতাছে, চা নিতাছে। বন্ধুগো লগে আড্ডা মারতাছে।”
বাবার চোখে জনি এখনও জীবন্ত, এখনও চঞ্চল। যে বয়সে বাবার কাঁধে ভর দিয়ে ছেলের পথ চলার কথা, সেই বয়সে জনিই হয়ে উঠেছিলেন তার বাবার অবলম্বন। বাবার আড়তের ব্যবসা বুঝে নিয়েছিলেন মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর আগে। তিন ছেলের মধ্যে জনিই ছিলেন সবচেয়ে দায়িত্বশীল।
মনির হোসেনের এই অশ্রু কেবল একজন পুত্রহারা বাবার নয়, এ যেন জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে সন্তান হারানো সকল বাবা-মায়ের প্রতিচ্ছবি। এই শোক, এই অপেক্ষা হয়তো কোনোদিনই শেষ হবে না।



