প্রকৃত ভালোবাসা বনাম প্রথাগত দাবি: আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: প্রত্যেক মুমিনের জীবনের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা হলো মহান আল্লাহ তা’আলার ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি অর্জন করা। কিন্তু কীভাবে সেই কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব? এটি কেবল একটি আবেগ বা অনুভূতি নয়, বরং এর জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট কর্ম ও আন্তরিক প্রচেষ্টা। প্রখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) আল্লাহর ভালোবাসা লাভের জন্য দশটি কার্যকর পথের নির্দেশনা দিয়েছেন, যা একজন মুমিনের জন্য পাথেয় হতে পারে।
আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের দশটি উপায়
বিখ্যাত এই আলেম আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের জন্য দশটি কার্যকর উপায় বর্ণনা করেছেন, যা নিম্নরূপ:
১. কুরআন অনুধাবন: গভীর মনোযোগের সাথে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা এবং এর অর্থ ও মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করা।
২. নফল ইবাদত: ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি নফল সালাত ও অন্যান্য আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সচেষ্ট থাকা।
৩. নিরবচ্ছিন্ন যিকির: সর্বাবস্থায়—ভাষা, অন্তর ও কর্মের মাধ্যমে—আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকা।
৪. আল্লাহর ভালোবাসাকে প্রাধান্য: যখন নিজের পছন্দ বা ভালোবাসা আল্লাহর পছন্দের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তখন নির্দ্বিধায় আল্লাহর ভালোবাসাকেই বেছে নেওয়া।
৫. আল্লাহর নাম ও গুণাবলি নিয়ে গবেষণা: আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ ও তাঁর সুমহান গুণাবলি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং এর মাহাত্ম্য অনুধাবন করা।
৬. নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা: আল্লাহর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অগণিত নিয়ামত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা এবং বান্দার প্রতি তাঁর করুণা ও অনুগ্রহকে স্মরণ করা।
৭. বিনয় ও আত্মসমর্পণ: সম্পূর্ণ বিনয়ের সাথে আল্লাহর সামনে নিজেকে পেশ করা এবং তাঁর কাছেই নিজের সকল প্রয়োজন তুলে ধরা।
৮. শেষ রাতের ইবাদত: রাতের শেষ তৃতীয়াংশে, যখন আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন, তখন নির্জনে তাঁর কাছে দোয়া, কান্নাকাটি, কুরআন তিলাওয়াত এবং ক্ষমা প্রার্থনায় লিপ্ত হওয়া।
৯. সৎসঙ্গ লাভ: আল্লাহর প্রিয় ও সৎকর্মশীল বান্দাদের সাহচর্যে থাকা এবং তাদের জ্ঞান ও উপদেশ থেকে উপকৃত হওয়া।
১০. অন্তরের প্রতিবন্ধকতা দূর করা: এমন সবকিছু থেকে দূরে থাকা যা বান্দার অন্তর ও আল্লাহর মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে।
রাসূল (ﷺ)-এর ভালোবাসার প্রকৃত স্বরূপ
আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের একটি অপরিহার্য শর্ত হলো তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ভালোবাসা। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন:
“তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং পৃথিবীর সকল মানুষের চেয়েও অধিক প্রিয় হই।” (সহীহ বুখারী, হাদিস: ১৫)
এর অর্থ হলো, যে ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-কে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে পারবে না, তার ঈমান পরিপূর্ণ হবে না।
রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ভালোবাসা মূলত আল্লাহর প্রতি ভালোবাসারই প্রতিফলন। আর এই ভালোবাসার অনিবার্য দাবি হলো তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করা। সুতরাং, যদি কেউ রাসূল (ﷺ)-কে ভালোবাসার দাবি করে, কিন্তু তাঁর আনীত দ্বীন ও সুন্নাহর বিরোধিতা করে; সুন্নাহকে ত্যাগ করে বিদআত, কুসংস্কার বা ভ্রান্ত পথের অনুসরণ করে, তবে তার ভালোবাসার দাবিটি অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে।
যারা রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহর বিপরীতে গিয়ে মীলাদ উদযাপন বা তাঁর প্রশংসায় এমন বাড়াবাড়ি করে যা শিরকের পর্যায়ে চলে যায়, এমনকি আল্লাহর পরিবর্তে তাঁর কাছে সাহায্য বা ফরিয়াদ জানায়, তাদের ভালোবাসার দাবিটি সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এমন লোকদের সম্পর্কে বলেন:
“তারা বলে, আমরা আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি এবং আনুগত্য স্বীকার করেছি। কিন্তু এরপর তাদের একটি দল মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ ধরনের লোকেরা কখনোই মুমিন নয়।” (সূরা আন-নূর: ৪৭)
যেহেতু তারা রাসূল (ﷺ)-এর নিষেধ করা কাজে লিপ্ত হয়ে তাঁর অবাধ্যতা করছে, তাই তাদের ভালোবাসার দাবিটি তাদের কর্মের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা আল্লাহর কাছে এ ধরনের ভ্রান্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।
( লেখাটি শাইখ ড. সালিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান রচিত এবং শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল মাদানি অনূদিত ‘আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত ও পরিমার্জিত। )



