অপরাধপ্রতারনাবাংলাদেশবিশ্লেষণসংগৃহীত সংবাদ

ফ্ল্যাট বুকিং: প্রতারণার ফাঁদ এড়াতে ক্রেতার করণীয়

বিশেষ প্রতিবেদন: স্বপ্নের একটি ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। ডেভেলপার কোম্পানির আকর্ষণীয় ব্রোশিওর আর মনোমুগ্ধকর বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে অনেক ক্রেতাই তাদের জীবনের অন্যতম বড় এই বিনিয়োগটি করার সময় প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করেন না। ফলস্বরূপ, নির্ধারিত সময়ে ফ্ল্যাট না পাওয়া, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার না করা, কিংবা আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার মতো অসংখ্য সমস্যায় পড়তে হয় তাদের।

আইনজীবীদের মতে, ফ্ল্যাট বুকিং দেওয়ার আগে এবং চুক্তি সম্পাদনের সময় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখলে এ ধরনের প্রতারণা থেকে সহজেই বাঁচা সম্ভব। অ্যাডভোকেট মো. মোজাম্মেল হকের পরামর্শ অনুযায়ী, একজন ক্রেতার করণীয় বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরা হলো।

১. বুকিং এবং প্রাথমিক অর্থ প্রদান

ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে সামান্য কিছু টোকেন মানি দিয়ে বুকিং দেওয়ার পরিবর্তে ডেভেলপার কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী ডাউন পেমেন্টের সম্পূর্ণ অর্থ পে-অর্ডারের মাধ্যমে প্রদান করা উচিত। এর মাধ্যমে লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। অর্থ প্রদানের আগেই কোম্পানির কাছে প্রকল্পের সব বৈধ কাগজপত্রের একটি ফটোকপি সেট চেয়ে নিন এবং জানিয়ে দিন যে, আপনি ডাউন পেমেন্টের অর্থ পরিশোধের দিনই নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তি স্বাক্ষর করতে চান।

২. প্রকল্পের বৈধতা যাচাই: যে কাগজপত্রগুলো দেখবেন

যেকোনো প্রকল্পে বিনিয়োগের আগে তার আইনি ভিত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক। ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে নিম্নোক্ত কাগজপত্রগুলো চেয়ে নিন এবং প্রয়োজনে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে সেগুলো যাচাই করুন:

  • জমির মালিকের সঙ্গে ডেভেলপার কোম্পানির সম্পাদিত চুক্তিপত্র।
  • ডেভেলপারের নামে রেজিস্ট্রিকৃত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (আমমোক্তারনামা)।
  • জমির মূল মালিকানার দলিল (সাফ কবলা)।
  • জমির ধারাবাহিক মালিকানার প্রমাণস্বরূপ বায়া দলিলসমূহ।
  • সব ধরনের খতিয়ানের কপি (সিএস, এসএ, আরএস এবং ঢাকা মহানগর জরিপ/সিটি জরিপ)।
  • আপ-টু-ডেট নামজারি, জমাভাগ, ডিসিআর এবং হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিশোধের রশিদ।
  • সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের রশিদ।
  • রাজউক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত প্ল্যানের কপি এবং নকশা।

এর যেকোনো একটি কাগজের ঘাটতি থাকলে সেই প্রকল্পে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।

৩. চুক্তিপত্র স্বাক্ষর: সর্বোচ্চ সতর্কতা

চুক্তিপত্র হলো ফ্ল্যাট কেনাবেচার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ডাউন পেমেন্ট দেওয়ার আগেই ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে চুক্তিপত্রের একটি খসড়া কপি চেয়ে নিন। চুক্তিপত্রটি ইংরেজিতে হলে এবং আপনার বুঝতে অসুবিধা হলে এর বাংলা সংস্করণ চেয়ে নিতে ইতস্তত করবেন না। কারণ, অনেক সময় ইংরেজি চুক্তির আইনগত মারপ্যাঁচে ক্রেতার স্বার্থবিরোধী শর্ত অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

চুক্তিপত্রে যে বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল করবেন:

  • পরিচয়: ক্রেতা ও ডেভেলপার কোম্পানির প্রতিনিধির পূর্ণাঙ্গ নাম, ঠিকানা এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর উল্লেখ আছে কি না।
  • অনুমোদন: রাজউকের প্ল্যান পাসের নম্বর ও তারিখ স্পষ্টভাবে লেখা আছে কি না।
  • মূল্য: ফ্ল্যাটের মোট মূল্য, কার পার্কিং এবং ইউটিলিটি চার্জ আলাদাভাবে উল্লেখ করে সর্বমোট মূল্য লেখা হয়েছে কি না।
  • কিস্তির বিবরণ: আলোচনা অনুযায়ী কিস্তি পরিশোধের সময়সূচি সঠিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কি না।
  • হস্তান্তরের তারিখ: ফ্ল্যাট হস্তান্তরের একটি সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ থাকা বাধ্যতামূলক। এই তারিখটি জমির মালিকের সাথে ডেভেলপারের চুক্তিতে উল্লিখিত তারিখের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা মিলিয়ে দেখুন।
  • বিলম্বের জরিমানা: নির্ধারিত তারিখে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হলে ডেভেলপার আপনাকে মাসিক কত টাকা ভাড়া বা ক্ষতিপূরণ দেবে, সেই শর্তটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করিয়ে নিন।
  • নির্মাণসামগ্রীর বিবরণ: ফ্ল্যাটে কী কী নির্মাণসামগ্রী (যেমন: টাইলস, ফিটিংস, রং) ব্যবহার করা হবে, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা (Features & Amenities) চুক্তিপত্রের অংশ হিসেবে সংযুক্ত করতে বলুন।
  • ব্রোশিওরের অন্তর্ভুক্তি: ফ্ল্যাট কেনার সময় আপনাকে যে ব্রোশিওরটি দেখানো হয়েছে, সেটিকেও “চুক্তিপত্রের অংশ” হিসেবে উল্লেখ করার জন্য অনুরোধ করুন, যেন ডেভেলপার পরবর্তীতে প্রতিশ্রুতি পরিবর্তন করতে না পারে।

৪. নির্মাণকাজ তদারকি

চুক্তি অনুযায়ী কিস্তির টাকা পরিশোধের পাশাপাশি প্রকল্পের নির্মাণকাজ ঠিকমতো এগিয়ে চলছে কি না, তা নিয়মিত তদারকি করা অত্যন্ত জরুরি। অনেক ডেভেলপার এক প্রকল্পের টাকা অন্য প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, ফলে সময়মতো নির্মাণকাজ শেষ হয় না। তাই, কাজের অগ্রগতির সাথে কিস্তি পরিশোধের বিষয়টি সমন্বয় করুন।

সঠিক পরিকল্পনা এবং আইনি বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন থাকলে ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button