কূপ থেকে সিংহাসনে: ধৈর্য ও প্রজ্ঞার এক অনন্য উপাখ্যান হযরত ইউসুফ (আ.)-এর জীবন থেকে আজকের দিনের শিক্ষা
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: পবিত্র কুরআনে বর্ণিত নবী-রাসুলদের কাহিনীর মধ্যে হযরত ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-এর জীবনী এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সূরা ইউসুফকে ‘আহসানুল কাসাস’ বা ‘সর্বোত্তম কাহিনী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই কাহিনীতে জিজ্ঞাসু ও চিন্তাশীলদের জন্য রয়েছে অগণিত শিক্ষা ও নির্দেশনা। হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর প্রপৌত্র এবং হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.)-এর জীবন ছিল ঈর্ষা, ষড়যন্ত্র, পরীক্ষা, ধৈর্য এবং अंतিমে আল্লাহর সাহায্যের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
স্বপ্নের ইঙ্গিত এবং ষড়যন্ত্রের সূচনা
ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী হযরত ইউসুফ (আ.) ছিলেন তাঁর ১১ ভাইয়ের মধ্যে রূপে-গুণে অনন্য। পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর স্নেহধন্য হওয়ায় অন্য ভাইয়েরা তাঁর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। শৈশবে তিনি এক অলৌকিক স্বপ্ন দেখেন, যেখানে সূর্য, চাঁদ এবং ১১টি নক্ষত্র তাঁকে সিজদা করছে। (সূরা ইউসুফ: ৪)
হযরত ইয়াকুব (আ.) এই স্বপ্নের গুরুত্ব অনুধাবন করে তাঁকে ভাইদের কাছে এটি প্রকাশ করতে নিষেধ করেন, কারণ তিনি তাদের ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা করছিলেন। এই স্বপ্ন ছিল ইউসুফ (আ.)-এর ভবিষ্যৎ মর্যাদা ও নবুয়তের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
ঈর্ষার বলি: কূপ থেকে দাসত্বের জীবন
ভাইদের বিদ্বেষ চরমে পৌঁছালে তারা ইউসুফ (আ.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। অবশেষে তাঁকে এক গভীর কূপে ফেলে দিয়ে আসে এবং তাঁর রক্তমাখা জামা দেখিয়ে পিতাকে জানায় যে, এক নেকড়ে বাঘ তাঁকে খেয়ে ফেলেছে।
কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। একটি বাণিজ্যিক কাফেলা কূপ থেকে তাঁকে উদ্ধার করে এবং মিসরে নিয়ে সামান্য মূল্যে বিক্রি করে দেয়। তাঁকে কিনে নেন মিসরের তৎকালীন আজিজ (একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী), যিনি তাঁকে নিজ সন্তানের মতো লালন-পালনের ব্যবস্থা করেন।
চরিত্রের পরীক্ষা এবং কারাগারের জীবন
যৌবনে হযরত ইউসুফ (আ.)-এর রূপ ও গুণে মুগ্ধ হয়ে আজিজের স্ত্রী জুলেখা তাঁকে অন্যায় কাজে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রগাঢ় আল্লাহভীতির কারণে ইউসুফ (আ.) সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং নিজেকে পবিত্র রাখেন। এর পরিণতিতে তাঁকে মিথ্যা অভিযোগে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।
কারাগারেই তাঁর প্রজ্ঞা ও আল্লাহর বিশেষ জ্ঞান প্রকাশিত হয়। তিনি সেখানে দুজন কয়েদির স্বপ্নের নির্ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা পরবর্তীতে তাঁর মুক্তির পথ প্রশস্ত করে।
সিংহাসনে আরোহণ এবং প্রজ্ঞার বিজয়
বহু বছর পর মিসরের বাদশাহ এক विचित्र স্বপ্ন দেখেন, যার ব্যাখ্যা দিতে রাজ্যের জ্ঞানী ব্যক্তিরা ব্যর্থ হন। তখন সেই মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদির মাধ্যমে বাদশাহ হযরত ইউসুফ (আ.)-এর কথা জানতে পারেন। ইউসুফ (আ.) স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বলেন যে, দেশে সাত বছর উর্বরতা ও সমৃদ্ধি আসবে এবং তার পরবর্তী সাত বছর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।
তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যাখ্যা ও দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার পরিকল্পনায় মুগ্ধ হয়ে বাদশাহ তাঁকে কারামুক্ত করেন এবং দেশের অর্থ ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।
ক্ষমতার শিখরে ক্ষমা ও মহত্ত্ব
দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য তাঁর ভাইয়েরা মিসরে আসে। হযরত ইউসুফ (আ.) তাদের চিনতে পারলেও তারা তাঁকে চিনতে পারেনি। বিভিন্ন ঘটনার পর যখন তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন, তখন ভাইয়েরা তাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়। কিন্তু হযরত ইউসুফ (আ.) প্রতিশোধের পরিবর্তে ক্ষমার এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
অবশেষে তিনি তাঁর পিতা-মাতাসহ পুরো পরিবারকে মিসরে নিয়ে আসেন এবং সেখানেই তাঁর শৈশবের দেখা স্বপ্নটি বাস্তবায়িত হয়, যখন তাঁর পরিবার তাঁকে সম্মানের সঙ্গে অভিবাদন জানায়।
সূরা ইউসুফ: কালজয়ী শিক্ষা
হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনাবহুল জীবন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক:
- ধৈর্যের প্রতিদান: চরম বিপদে ধৈর্য ধারণ করলে আল্লাহ অবশ্যই উত্তম প্রতিদান দেন।
- তাকওয়া ও পবিত্রতা: গোপনে ও একান্তে আল্লাহকে ভয় করে পাপ থেকে বিরত থাকাই প্রকৃত ঈমানের পরিচয়, যা মানুষকে সর্বোচ্চ সম্মানে আসীন করে।
- ক্ষমার মাহাত্ম্য: প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করা মহত্ত্বের লক্ষণ।
- আল্লাহর পরিকল্পনা: মানুষের জীবনে আপাত কষ্ট ও পরীক্ষার আড়ালেই অনেক সময় আল্লাহর মহান পরিকল্পনা ও কল্যাণ নিহিত থাকে।
- সত্যনিষ্ঠার বিজয়: সত্যবাদিতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা সাময়িকভাবে সংকটে ফেললেও চূড়ান্ত বিজয় অবশ্যম্ভাবী।



