শ্রেষ্ঠ উম্মাহর মর্যাদা ও পুরস্কার: কুরআন ও হাদিসের আলোকে উম্মতে মুহাম্মদীর দায়িত্ব ও প্রতিদান
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা মানবজাতির মধ্যে উম্মতে মুহাম্মদীকে “খাইরা উম্মাহ” বা ‘শ্রেষ্ঠতম জাতি’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সূরা আলে ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ, দায়িত্ব এবং পুরস্কারের এক পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে, যা এই উম্মতের বিশেষ মর্যাদা ও জবাবদিহিতার প্রমাণ বহন করে।
শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি: দায়িত্ব ও ঈমান
আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।” (সূরা আলে ইমরান: ১১০)
এই আয়াত অনুসারে, উম্মতে মুহাম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব কোনো জাতিগত বা বংশীয় কারণে নয়, বরং তিনটি মৌলিক দায়িত্ব পালনের শর্তে অর্জিত:
১. সৎকাজের আদেশ (আমর বিল মা’রূফ): সমাজের প্রতিটি স্তরে ন্যায়, কল্যাণ ও শরীয়তসম্মত কাজের প্রসার ঘটানো এবং মানুষকে তার দিকে আহ্বান করা।
২. অসৎকাজে নিষেধ (নাহি আনিল মুনকার): সকল প্রকার অন্যায়, পাপাচার ও আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করা।
৩. আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান: তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাতসহ ঈমানের সকল স্তম্ভের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা, যা উপরিউক্ত দুটি দায়িত্ব পালনের মূল চালিকাশক্তি।
আয়াতটিতে আরও বলা হয়েছে যে, এই উম্মতকে কেবল নিজেদের জন্য নয়, বরং সমগ্র “মানবজাতির কল্যাণের জন্য” আবির্ভূত করা হয়েছে। এটি তাদের ওপর অর্পিত এক বৈশ্বিক দায়িত্ব।
প্রতিদানের বিশেষত্ব: অল্প আমলে অধিক সওয়াব
এই বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে আল্লাহ তাআলা এই উম্মতকে প্রতিদান ও পুরস্কারের ক্ষেত্রেও স্বতন্ত্র সম্মান দান করেছেন। সৎকাজের প্রতিদান বহুগুণে বৃদ্ধি করার নীতিটি বিশেষভাবে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এক বিরাট সুসংবাদ।
১. সর্বনিম্ন দশগুণ প্রতিদান:
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন: “যে কেউ একটি সৎকর্ম নিয়ে আসবে, সে তার দশগুণ (প্রতিদান) পাবে; আর যে কেউ একটি মন্দ কর্ম নিয়ে আসবে, সে তার সমান ছাড়া অন্য কোনো প্রতিদান পাবে না।” (সূরা আল-আন’আম: ১৬০)
মুফাসসিরদের মতে, প্রতিটি নেক কাজের বিনিময়ে কমপক্ষে দশগুণ সওয়াব প্রাপ্তি এই উম্মতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ অনুগ্রহ। সহীহ হাদিসেও পূর্ববর্তী উম্মতদের তুলনায় অল্প সময়ে কাজ করে বেশি প্রতিদান পাওয়ার উদাহরণ দিয়ে এই উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা হয়েছে।
২. বহুগুণে বর্ধিত পুরস্কার:
এই দশগুণ প্রতিদানের বিশেষ অনুগ্রহের পর আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের আরও উৎসাহিত করতে ‘উত্তম ঋণ’ বা ‘ক্বারদে হাসানা’-এর ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলেন: “কে আছে যে আল্লাহকে ‘উত্তম ঋণ’ দেবে? তিনি তাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন।” (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৪৫)
হাদিসের আলোকে, আল্লাহর পথে করা এই দান বা সৎকাজকে তিনি নিজের জন্য ঋণ হিসেবে গণ্য করেন এবং এর প্রতিদান ক্ষেত্রবিশেষে সত্তর থেকে সাতশো গুণ বা তারও বেশি বৃদ্ধি করে দেন।
৩. ধৈর্যশীলদের জন্য অপরিমিত পুরস্কার:
প্রতিদানের সর্বোচ্চ স্তরটি বর্ণনা করা হয়েছে ধৈর্যশীলদের জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেন: “বলো, ‘হে আমার মুমিন বান্দারা, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো… নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের তাদের পুরস্কার হিসাব ছাড়া পুরোপুরি দেওয়া হবে’।” (সূরা আয-যুমার: ১০)
এই আয়াতে ‘সবর’ বা ধৈর্যের প্রতিদানকে কোনো গণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। যারা বিপদে, ইবাদতে এবং পাপ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাদের অগণিত ও অপরিমিত পুরস্কারে ভূষিত করবেন।
সুতরাং, উম্মতে মুহাম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব একাধারে একটি বড় দায়িত্ব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অকল্পনীয় পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের মাধ্যমে অর্জিত এই মর্যাদা তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভের সুযোগ করে দেয়।



