ইসলাম ধর্ম

মুমিনরা পরস্পরের ভাই: কুরআনের আলোয় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলাম ধর্মে মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ককে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, “মু’মিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই।” (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১০)। এই একটি আয়াতই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে একতা, সৌহার্দ্য এবং সহযোগিতার এক সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে।

পবিত্র কুরআনের সূরা আল-হুজুরাতের ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “অতএব তোমাদের ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করে দাও। আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের প্রতি মেহেরবানী করা হবে।” এই আয়াতে শুধুমাত্র ভ্রাতৃত্বের ঘোষণাই নয়, বরং মুসলিমদের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে তা মীমাংসা করে দেওয়ারও জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এটি এক বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বের আহ্বান, যা বর্ণ, গোত্র, ভাষা বা ভৌগোলিক সীমানার ঊর্ধ্বে।

এর আগের আয়াতে, অর্থাৎ সূরা আল-হুজুরাতের ৯ নম্বর আয়াতে, এই ভ্রাতৃত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আয়াতে বলা হয়েছে, “ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।” যদি কোনো এক পক্ষ বাড়াবাড়ি করে, তবে ন্যায়ের পক্ষে অন্য পক্ষকে অবস্থান নিতে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর আদেশের দিকে ফিরে আসে। বিবদমান দলগুলোর মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে মীমাংসা করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, “আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।”

রাসূলুল্লাহ (সঃ) বিভিন্ন সহীহ হাদীসে এই ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে অত্যাচারী হোক অথবা অত্যাচারিত হোক।” সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলে তিনি ব্যাখ্যা দেন যে, অত্যাচারীকে সাহায্য করার অর্থ হলো তাকে অত্যাচার থেকে বিরত রাখা। এটিই হলো ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের প্রকৃত কল্যাণকামিতা।

আরেকটি সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “আল্লাহ ততক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করতে থাকেন যতক্ষণ বান্দা তার (মুমিন) ভাইকে সাহায্য করতে থাকে।” এই হাদীসটি পারস্পরিক সহযোগিতার এক অসাধারণ অনুপ্রেরণা জোগায়। এটি স্পষ্ট করে যে, অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সাহায্যই লাভ করা যায়।

মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্ক কতটা গভীর হওয়া উচিত, তা বোঝাতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি অনন্য উপমা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “মুসলমানের পরিস্পরিক প্রেম-প্রীতি, দয়া-সহানুভূতি ও মিলামিশার দৃষ্টান্ত একটি দেহের মত। যখন কোন অঙ্গে ব্যথা হয় তখন গোটা দেহ ঐ ব্যথা অনুভব করে, সারা দেহে জ্বর এসে যায় এবং সারা দেহ জেগে থাকার কষ্ট পায়।”

অন্য আরেকটি হাদীসে তিনি বলেছেন, “এক মুমিন অপর মুমিনের জন্যে একটি দেয়ালের মত, যার একটি অংশ অপর অংশকে শক্ত ও দৃঢ় করে।” এই উপমাটি মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তাকে নির্দেশ করে।

বস্তুত, ঈমানদারদের মধ্যকার সম্পর্ক শুধু আনুষ্ঠানিক নয়, বরং তা আত্মার। হযরত সাহল ইবনে সা’দ সায়েদী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “মুমিনের ঈমানদারের সাথে ঐ সম্পর্ক রয়েছে, যে সম্পর্ক মাথার দেহের সাথে রয়েছে।” অর্থাৎ, এক মুমিনের কষ্ট অপর মুমিন সেভাবেই অনুভব করবে, যেভাবে মাথার ব্যথা পুরো শরীর অনুভব করে।

এই আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামে মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেবল কথার কথা নয়, বরং এটি এক গভীর বিশ্বাস ও দায়িত্বের অংশ। আজ বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহর ক্রান্তিকালে এই ভ্রাতৃত্বের শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরাই হতে পারে শান্তি, ঐক্য এবং অগ্রগতির একমাত্র পথ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button