ইসলাম ধর্ম

গীবত: মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সমতুল্য পাপ এবং এর ভয়াবহ পরিণতি

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা কেবল ইবাদতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক সম্পর্ক ও আচার-আচরণ নিয়েও সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে। মানুষের পারস্পরিক সম্মান ও সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য পবিত্র কুরআনের সূরা আল-হুজুরাতে কিছু ভয়াবহ পাপ থেকে বিরত থাকার জন্য কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো গীবত বা পরনিন্দা। এই পাপকে আল্লাহ তায়ালা এতটাই ঘৃণা করেন যে, একে মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন।

কুরআনের কঠোর হুঁশিয়ারি

সূরা আল-হুজুরাতের ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে সম্বোধন করে বলেন:

আয়াত ১১: “হে ঈমানদারগণ, কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে বিদ্রূপ না করে; হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ না করে; হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অপরকে দোষারোপ করো না এবং পরস্পরকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা অতি জঘন্য কাজ। যারা এ থেকে তওবা করে না, তারাই জালেম।”

আয়াত ১২: “হে ঈমানদারগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাকো। নিশ্চয়ই কোনো কোনো অনুমান পাপ। আর তোমরা দোষ অন্বেষণ করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া পছন্দ করবে? অবশ্যই তোমরা তা ঘৃণা করবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”

গীবত কী? রাসূল (সাঃ)-এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা

গীবত বা পরনিন্দা কী, সে সম্পর্কে অনেকেই বিভ্রান্তিতে ভোগেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর এক কথায় সমাধান দিয়েছেন। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! গীবত কী?” তিনি বললেন, “তোমার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কিছু বলা, যা সে শুনলে অপছন্দ করত।” তখন জিজ্ঞেস করা হলো, “আমি যা বলছি, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সত্যিই থেকে থাকে?” তিনি উত্তরে বললেন, “তুমি যা বলছ, তা যদি তার মধ্যে থাকে, তবেই তা গীবত। আর যদি না থাকে, তবে তা অপবাদ (বুহতান)।” (আবু দাউদ)

একবার হযরত আয়েশা (রাঃ) একজন খাটো মহিলা সম্পর্কে ইশারায় মন্তব্য করলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বলেছিলেন, “তুমি তার গীবত করলে!”

গীবতের ভয়াবহ পরিণতি: দুনিয়া ও আখিরাতে

গীবত কেবল একটি সামাজিক অপরাধই নয়, বরং এর জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

  • মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ: কুরআন গীবতকে মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার মতো জঘন্য কাজের সাথে তুলনা করে এর বীভৎসতা তুলে ধরেছে।
  • মিরাজের রাতের দৃশ্য: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “মিরাজের রাতে আমি এমন কিছু লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাদের নখগুলো তামার তৈরি এবং তা দিয়ে তারা নিজেদের মুখ ও বুক আঁচড়াচ্ছিল। আমি জিবরাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা তারাই যারা মানুষের মাংস খেত (গীবত করত) এবং তাদের সম্মানহানি করত।” (আবু দাউদ)
  • দুনিয়াতেই লাঞ্ছনা: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সতর্ক করে বলেন, “হে সেসব লোক, যারা মুখে ঈমান এনেছ কিন্তু অন্তরে আনোনি! তোমরা মুসলমানদের গীবত করো না এবং তাদের গোপন দোষ খুঁজে বেড়িও না। কারণ যে ব্যক্তি অন্যের দোষ খুঁজবে, আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দেবেন এবং তাকে তার নিজের ঘরেই লজ্জিত করবেন।” (আবু দাউদ)
  • মৃত গাধার মাংসের চেয়েও জঘন্য: একবার হযরত মায়েয (রাঃ)-কে ব্যভিচারের অপরাধে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে দুজন লোক নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, “লোকটাকে কুকুরের মতো হত্যা করা হলো।” রাসূল (সাঃ) তাদের এই কথা শুনে কিছুদূর গিয়ে একটি মৃত গাধার দিকে ইশারা করে বললেন, “তোমরা নামো এবং এই গাধার মাংস খাও।” তারা বলল, “হে আল্লাহর রাসূল! এটা কে খাবে?” তিনি বললেন, “তোমরা তোমাদের ভাইয়ের যে সম্মানহানি করেছ, তা এই মৃত গাধার মাংস খাওয়ার চেয়েও জঘন্য।”

ব্যতিক্রম:
তবে ইসলামে শরীয়তের প্রয়োজনে, যেমন—কাউকে বড় ধরনের ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য সতর্ক করা, বিয়ের প্রস্তাবের ক্ষেত্রে পাত্র বা পাত্রীর দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে অবহিত করা, কিংবা প্রকাশ্য পাপাচারীর সম্পর্কে বলার অনুমতি রয়েছে।

সর্বোপরি, গীবত, বিদ্রূপ, অনুমান এবং দোষারোপের মতো পাপগুলো একটি সুন্দর সমাজকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দেয়। তাই আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে এসব থেকে বেঁচে থাকার এবং তওবা করার আহ্বান জানিয়েছেন, কারণ তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু।

(উৎস: সূরা আল-হুজুরাতের তাফসির এবং সংশ্লিষ্ট হাদিস গ্রন্থসমূহ)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button