অপরাধগাজীপুরদুর্নীতিদেশপ্রশাসনবাংলাদেশসংগৃহীত সংবাদসম্পাদকীয়

ঘুষের আখড়ায় পরিণত শ্রীপুর থানা, ওসি বারিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

ডেস্ক রিপোর্ট: গাজীপুরের শ্রীপুর থানা এখন ঘুষ আর মামলা বাণিজ্যের এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুল বারিকের বিরুদ্ধে অর্থ নিয়ে গভীর রাতে আওয়ামী লীগ নেতাকে মুক্তি দেওয়া, মামলার ধারা পরিবর্তন করা এবং মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেওয়াসহ চাঞ্চল্যকর সব অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাত্র পাঁচ মাসের দায়িত্বে তিনি থানাকে এক ঘুষের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন বলে দাবি ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের।

আমাদের অনুসন্ধানে ওসি বারিকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগের তথ্য উঠে এসেছে। যদিও পুলিশের হয়রানির ভয়ে অনেকেই মুখ খুলতে রাজি হননি, তবে কয়েকজন ভুক্তভোগী তার ঘুষকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। স্থানীয়দের ভাষ্য, গত বছরের ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর শ্রীপুর থানায় ঘুষের প্রবণতা অনেকটাই কমে এসেছিল। কিন্তু ওসি বারিক যোগদানের পর থেকেই পুরোনো সেই দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্কৃতি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন টাকা ছাড়া থানায় কোনো কাজ হয় না বললেই চলে।

গভীর রাতে থানা থেকে ছাড়া পেলেন আওয়ামী লীগ নেতা

গত রোববার (১২ অক্টোবর) বিকেলে শ্রীপুর পৌর আওয়ামী লীগের সদস্য নুরুল আমীনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারের বিষয়টি ওসি আব্দুল বারিক নিজেই সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, থানা হেফাজতে থাকা অবস্থায় ওইদিন দিবাগত রাত ৩টার দিকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এই মুক্তি মিলেছে।

এ বিষয়ে ওসি বারিকের দাবি, নুরুল আমীনের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি এবং তার পিতার নামেও গরমিল ছিল, তাই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গভীর রাতে থানা হেফাজত থেকে আসামি ছেড়ে দেওয়ার এখতিয়ার ওসির আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে গাজীপুর বারের সিনিয়র আইনজীবী আসাদুল্লাহ বাদল বলেন, “কোনো সুযোগ নেই। এটি আদালতের কাজ, ওসির নয়।” এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সদুত্তর দিতে পারেননি।

দুই লাখ টাকায় মামলার ধারা পরিবর্তন

গত ৪ অক্টোবর ফারুক আহমেদ নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে গ্রেপ্তারের পর তার স্বজনদের কাছে মামলার ধারা হালকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে ২ লাখ টাকায় রফাদফা হয়। একটি প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে এই লেনদেন হয় বলে আমাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। তবে চুক্তির পুরোটা রক্ষা না করায় ওসি এক লাখ টাকা ফেরত দেন বলেও জানা গেছে, যার ভিডিও প্রমাণ একজন টেলিভিশন সাংবাদিক আমাদের সরবরাহ করেছেন।

৫০ হাজার টাকায় মাদক ব্যবসায়ীর মুক্তি

গত ৩১ জুলাই রাতে মারুফ নামের এক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীকে মাদক সেবনরত অবস্থায় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি একাধিক মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, রাত ৩টার দিকে, ৫০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়ার পর মারুফ নিজেই এই তথ্য স্বীকার করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি আব্দুল বারিক প্রথমে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও প্রতিবেদকের কাছে প্রমাণ থাকার কথা শুনে বলেন, “আচ্ছা, আমি কথা বলে দেখতেছি।”

জুলাই হত্যা মামলার আসামি যখন মারামারির মামলায়

ময়মনসিংহের সাবেক এমপি কাজিম উদ্দিন ধনুর ব্যক্তিগত সহকারী সায়েম কবিরকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে জুলাই হত্যাকাণ্ডের ১০-১২টি মামলা থাকলেও ওসি আব্দুল বারিক আড়াই লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে তাকে একটি সাধারণ মারামারির মামলায় চালান দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই লেনদেনের সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) এসআই নাজমুলও ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে জানা যায়। তবে এসআই নাজমুল আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

এসব গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে জানতে গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) ড. চৌধুরী মোহাম্মদ যাবের সাদেককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। শ্রীপুর থানার এই বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্য ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনায় পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button