ইসলাম ধর্ম

জিন জাতির উত্থান-পতন: বারবার অবাধ্যতা, ঐশী গজব এবং ইবলীসের উত্থান

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: মানব সৃষ্টির বহু পূর্ব থেকে পৃথিবীতে জিন জাতির বসবাস। তাদের ইতিহাস অত্যন্ত দীর্ঘ এবং ঘটনাবহুল, যা বারবার অবাধ্যতা এবং ঐশী শাস্তির চক্রে আবর্তিত হয়েছে। জিন জাতির আদি পিতা আবুল জিনের পর থেকে প্রায় ছত্রিশ হাজার বছর ধরে তাদের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছিলেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিপথগামী হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

অবাধ্যতার সূচনা ও ফেরেশতাদের হস্তক্ষেপ

জিন জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য যখনই কোনো পয়গম্বর প্রেরিত হতেন, স্বল্পসংখ্যক জিন তাঁর আদর্শ গ্রহণ করলেও অধিকাংশই পাপাচার ও অবাধ্যতায় লিপ্ত থাকত। তারা কেবল নবীদের নির্দেশ অমান্য করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং বহু পয়গম্বরকে নির্মমভাবে হত্যাও করে। তাদের সীমাহীন পাপাচারের কারণে আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং তাদের ধ্বংস করার জন্য আসমান থেকে ফেরেশতাদের এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন।

ফেরেশতাদের আক্রমণে কোটি কোটি পাপিষ্ঠ জিন নিহত হয়। সে সময় কেবল মুষ্টিমেয় ঈমানদার জিন, যারা লোকালয় ছেড়ে পাহাড়ের গুহা ও বন-জঙ্গলে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত ছিল, তারাই প্রাণে রক্ষা পায়। এই বেঁচে যাওয়া জিনদের মাধ্যমেই পৃথিবীতে পুনরায় জিন জাতির বিস্তার ঘটে। কিন্তু কালের বিবর্তনে তাদের বংশধরেরাও পূর্বপুরুষদের মতো পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং আবারও একজন পয়গম্বরকে হত্যা করে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পুণ্যবান জিনের দল পুনরায় বন-জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। আল্লাহ তায়ালা আবার ফেরেশতা পাঠিয়ে পাপী জিনদের ধ্বংস করেন।

চালপালিশ, বিলীকা ও হামুসের শাসনকাল

বারবার ধ্বংসযজ্ঞের পর বেঁচে থাকা অল্পসংখ্যক জিনের মধ্যে চালপালিশ নামক একজন অত্যন্ত ধার্মিক ও জ্ঞানী জিন ছিলেন। আল্লাহ তাকেই জিনদের বাদশাহ ও ধর্মীয় নেতা মনোনীত করেন। চালপালিশের শাসনামলে জিন জাতি কিছুদিন শান্তি ও শৃঙ্খলার সাথে জীবনযাপন করে। কিন্তু একপর্যায়ে তিনি নিজেও পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। আল্লাহ তায়ালা জিবরাঈল (আঃ)-কে পাঠিয়ে তাকে সতর্ক করলে তিনি অনুতপ্ত হয়ে সঠিক পথে ফিরে আসেন। তবে দুষ্ট জিনদের প্ররোচনায় তিনি পুনরায় পাপের স্রোতে গা ভাসান, যার ফলে আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা তাকেসহ সমগ্র জিন জাতিকে ধ্বংস করে দেয়।

এরপর বিলীকা নামক আরেকজন পুণ্যবান জিনকে নবুয়ত ও রাজত্ব দান করা হয়। পঁচিশ হাজার বছর বয়সে দায়িত্ব পেয়ে তিনি চৌত্রিশ বছর সফলভাবে শাসন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তার জাতি এবং তিনি নিজেও পথভ্রষ্ট হয়ে পড়লে পুনরায় আল্লাহর গজব নেমে আসে এবং বিলীকাসহ প্রায় সকল জিন ধ্বংস হয়ে যায়।

একইভাবে হামুস নামক আরেকজন সৎ জিনকে পয়গম্বর ও বাদশাহ নিযুক্ত করা হয়। আল্লাহ তাকে পূর্ববর্তীদের করুণ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে সতর্ক করে দেন। হামুস যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি দিলেও কিছুদিন পর তার জাতি বিপথগামী হয়ে যায় এবং প্রলোভনে পড়ে তিনিও তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।

চূড়ান্ত সংঘাত এবং ইবলীসের সন্ধান

জিনদের আদি-পিতা তারাননুসের জন্মের প্রায় এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার বছর পর তাদের পাপাচার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। তখন আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের সমগ্র জিন জাতিকে নির্মূল করার আদেশ দেন। এবার জিনরাও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ফেরেশতাদের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু ঐশী শক্তির অধিকারী ফেরেশতাদের সামনে তাদের প্রতিরোধ মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় এবং অল্প কয়েকজন ছাড়া সমগ্র জিন জাতি ধ্বংস হয়ে যায়।

এই ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে ফেরেশতারা এক হাজার বছর বয়সী এক অপরূপ সুন্দর জিন বালককে দেখতে পায়। তার প্রতি তাদের মনে মমতার উদ্রেক হলে তারা তাকে হত্যা না করে আল্লাহর কাছে আবেদন জানায়, “হে প্রভু! এই বালকটির প্রতি আমাদের মায়া জন্মেছে। আপনার অনুমতি পেলে আমরা তাকে আসমানে নিয়ে গিয়ে পরম স্নেহে লালন-পালন করতে চাই।”

আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রার্থনা কবুল করেন। ফেরেশতারা অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বালকটিকে আসমানে নিয়ে যায় এবং তার নাম রাখে ‘ইবলীস’। ফেরেশতাদের এই দয়া ও একটি জিন বালকের রক্ষা পাওয়ার পেছনে যে এক সুদূরপ্রসারী ঐশী পরিকল্পনা লুকিয়ে ছিল, তা ছিল তখনকার মতো সকলের ধারণার বাইরে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button