সূরা ইয়াসীনে বর্ণিত ‘মুহতাদূন’: কুরআনের আলোকে সৎপথপ্রাপ্তদের বৈশিষ্ট্য
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতির জন্য হিদায়াত বা সৎপথের দিশা দিয়েছেন। যারা এই পথ অনুসরণ করেন, তাদের ‘মুহতাদূন’ বা হিদায়াতপ্রাপ্ত বলে অভিহিত করা হয়েছে। সূরা ইয়াসীনের ২০ ও ২১ নম্বর আয়াতে এমন একজন ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যিনি নগরীর দূরপ্রান্ত থেকে ছুটে এসে পয়গম্বরদের অনুসরণ করার জন্য নিজ সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা রাসূলদের অনুসরণ কর। অনুসরণ কর তাঁদের, যাঁরা তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চান না এবং যাঁরা ‘মুহতাদূন’ (সৎপথপ্রাপ্ত)।”
এই ‘মুহতাদূন’ বা সৎপথপ্রাপ্তদের বৈশিষ্ট্যগুলো কী? পবিত্র কুরআন জুড়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁদের বিভিন্ন গুণাবলি তুলে ধরেছেন, যা একজন বিশ্বাসীর জন্য অনুসরণীয়। নিচে কুরআনের আলোকে তাঁদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো:
১. তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন:
হিদায়াতপ্রাপ্তদের মূল ভিত্তি হলো তাকওয়া। তাঁরা প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বদা আল্লাহকে ভয় করেন এবং তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকতে সচেষ্ট থাকেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “এটাই সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা মুত্তাকীদের জন্য পথনির্দেশ।” (সূরা আল-বাকারা: ২)। বস্তুত, তাকওয়াই মানুষকে হিদায়াতের পথে পরিচালিত করার প্রধান শক্তি।
২. অদৃশ্যের প্রতি দৃঢ় ঈমান:
তাঁরা অদৃশ্য জগতের বিষয়গুলোতে, যেমন—আল্লাহর অস্তিত্ব, ফেরেশতা, পরকাল এবং শেষ বিচার দিবসের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করেন। এই বিশ্বাসই তাঁদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। আল্লাহ বলেন, “যারা গায়বের প্রতি ঈমান আনে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদের যা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।” (সূরা আল-বাকারা: ৩)।
৩. সালাত প্রতিষ্ঠায় যত্নশীল হওয়া:
নামাজ বা সালাত হলো হিদায়াতপ্রাপ্তদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁরা অত্যন্ত যত্ন ও নিষ্ঠার সাথে সালাত আদায় করেন, যা তাঁদেরকে আধ্যাত্মিক শক্তি জোগায় এবং অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। যেমনটি বলা হয়েছে, “এবং যারা তাদের সালাতে যত্নবান (সালাতের হিফাজত করে)।” (সূরা আল-মুমিনুন: ৯)।
৪. ঐশী কিতাব ও নবীদের প্রতি বিশ্বাস:
তাঁরা কেবল পবিত্র কুরআনের উপরই নয়, বরং পূর্বে অবতীর্ণ সকল ঐশী কিতাব এবং প্রেরিত নবীদের প্রতিও ঈমান রাখেন। এই বিশ্বাস তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে এবং ঐক্যের পথে পরিচালিত করে। আল্লাহ বলেন, “আর যারা বিশ্বাস করে তোমার প্রতি যা নাজিল করা হয়েছে এবং তোমার আগে যা নাজিল করা হয়েছে এবং আখিরাতে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে।” (সূরা আল-বাকারা: ৪)।
৫. ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দেওয়া:
জীবনের যেকোনো কঠিন পরীক্ষা ও প্রতিকূলতায় হিদায়াতপ্রাপ্তরা ধৈর্য ধারণ করেন এবং আল্লাহর সাহায্যের ওপর অটল থাকেন। তাঁদের এই গুণটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আর যারা তাদের রবের সন্তুষ্টি কামনায় ধৈর্য ধারণ করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে…এদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম।” (সূরা আর-রাদ: ২২)।
৬. আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা (তাওয়াক্কুল):
তাঁরা নিজেদের সকল বিষয় আল্লাহর ওপর সোপর্দ করেন এবং বিশ্বাস করেন যে, তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ও সর্বোত্তম। এই তাওয়াক্কুল তাঁদের মানসিক প্রশান্তি দেয় এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে অবিচল থাকতে সাহায্য করে। আল্লাহ বলেন, “আর যারা ঈমান এনেছে, তাদের কাজ হলো শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করা।” (সূরা আশ-শুরা: ৩৬)।
৭. আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করা:
হিদায়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ থেকে তাঁরই পথে উদারভাবে ব্যয় করেন। তাঁদের এই দানशीलता ও মানবকল্যাণমূলক কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম উপায়। সূরা বাকারার ৩ নম্বর আয়াতে এই গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
৮. আখিরাতের প্রতি অবিচল বিশ্বাস:
তাঁদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আখিরাতের সাফল্য। তাই তাঁরা দুনিয়ার জীবনের মোহ ত্যাগ করে পরকালীন প্রস্তুতির জন্য কাজ করেন। এই বিশ্বাস তাঁদেরকে সৎকর্মে অনুপ্রাণিত করে এবং পাপ থেকে দূরে রাখে। যেমনটি কুরআনে বলা হয়েছে, “যারা আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে।” (সূরা আল-বাকারা: ৪)।
৯. সীমালঙ্ঘন ও অন্যায় থেকে বিরত থাকা:
তাঁরা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা মেনে চলেন এবং যেকোনো ধরনের অন্যায় ও অবিচার থেকে নিজেদের বিরত রাখেন। ন্যায়পরায়ণতা তাঁদের চরিত্রের অন্যতম ভূষণ। আল্লাহ বলেন, “আর যারা সীমালঙ্ঘন করে না।” (সূরা আন-নামল: ৯)।
উপসংহার:
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট যে, ‘মুহতাদূন’ বা হিদায়াতপ্রাপ্তদের জীবন আল্লাহর নির্দেশনার আলোকে পরিচালিত হয়। তাঁদের তাকওয়া, ঈমান, ধৈর্য, ন্যায়পরায়ণতা এবং পরকালের প্রতি অবিচল বিশ্বাস আমাদের সকলের জন্য এক মহান আদর্শ। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত এই গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমেই একজন মানুষ প্রকৃত অর্থে সৎপথপ্রাপ্ত হতে পারে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হতে পারে।



