ইসলাম ধর্ম

পরকালের শাস্তি জাহান্নাম: কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমাদের উপলব্ধি ও মুক্তির পথ

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলাম ধর্মে ঈমানের অন্যতম ভিত্তি হলো পরকালীন জীবনে বিশ্বাস, যার দুটি চূড়ান্ত পরিণতি—জান্নাত ও জাহান্নাম। এর মধ্যে জাহান্নাম হলো সীমালঙ্ঘনকারী ও পাপীদের জন্য এক ভয়াবহ শাস্তির স্থান। কিন্তু পরম দয়ালু আল্লাহ কেন এমন শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন? কেনই বা এর ভয়াবহতা জেনেও মানুষ সতর্ক হয় না? কোরআন ও হাদিসের আলোকে এই গভীর প্রশ্নগুলোর উত্তর এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায় নিয়েই আজকের আলোচনা।

জাহান্নামের পরিচয় ও সৃষ্টির কারণ

‘জাহান্নাম’ (আরবি ‘নার’) হলো পরকালে কাফের, মুশরিক এবং পাপী বান্দাদের জন্য নির্ধারিত চূড়ান্ত শাস্তির আবাস। এর ভয়াবহতা বোঝাতে পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন নামে একে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন—সাঈর (প্রজ্বলিত আগুন), লাযা (লেলিহান অগ্নি), সাকার (চামড়া ঝলসে দেওয়া আগুন) এবং হুতামা (চূর্ণ-বিচূর্ণকারী)।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “অতঃপর যারা সীমালঙ্ঘন করেছে এবং পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছে, নিশ্চয় জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা।” (সূরা আন-নাযিয়াত: ৩৭-৩৯)

জাহান্নাম সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর অসীম প্রজ্ঞা ও ন্যায়বিচার নিহিত রয়েছে। এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো:

১. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: পৃথিবীতে যারা অহংকার, জুলুম, শিরক, কুফর এবং আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে জীবন অতিবাহিত করেছে, তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত প্রতিফল দেওয়াই এর মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ বলেন, “আমি অত্যাচারীদের জন্য আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি, যার প্রাচীর তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে।” (সূরা আল-কাহফ: ২৯)

২. মানবজাতির জন্য সতর্কবার্তা: জাহান্নামের বর্ণনা মূলত মানুষকে পাপকাজ থেকে বিরত রেখে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য একটি সতর্কবার্তা। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ভালোবাসেন বলেই এই ভয় দেখিয়েছেন, যাতে তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে। যেমন তিনি বলেন, “তোমরা সেই আগুন থেকে বাঁচার ব্যবস্থা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে কাফেরদের জন্য।” (সূরা আল-বাকারা: ২৪)

প্রেমময় স্রষ্টার শাস্তি: একটি গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা

একটি বহুল প্রচলিত হাদিস অনুযায়ী, আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ৭০ জন মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে, এতটা প্রেমময় হওয়া সত্ত্বেও তিনি কেন বান্দাকে শাস্তি দেবেন?

এর উত্তর হলো, আল্লাহর ভালোবাসা তাঁর ক্ষমা ও করুণার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, কিন্তু তাঁর ন্যায়বিচারও তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। তিনি মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য নবী-রাসূল ও আসমানি কিতাব পাঠিয়েছেন এবং তওবার দরজা সর্বদা খোলা রেখেছেন। জাহান্নামের শাস্তি তাদের জন্য, যারা স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে আল্লাহর এই দয়া ও হেদায়েতকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যারা পৃথিবীতে জুলুম করেছে, তাদের শাস্তি না দেওয়া হলে সৎকর্মশীলদের প্রতি অবিচার করা হতো। সুতরাং, জাহান্নাম হলো সেই বান্দার পরিণতি, যে নিজেই নিজের কর্মের মাধ্যমে শাস্তিকে বেছে নিয়েছে।

বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও উপলব্ধির অভাব কেন?

অনেক বিশ্বাসী মুসলমান জাহান্নামের অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও এর ভয়াবহতা সেভাবে উপলব্ধি করতে পারেন না। এর প্রধান কারণগুলো হলো:

  • দুনিয়ার মোহ (গাফলাতি): পার্থিব জীবনের ভোগ-বিলাস, অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতার মোহ অন্তরকে এতটাই আচ্ছন্ন করে ফেলে যে, পরকালের ভাবনা থেকে মানুষ উদাসীন হয়ে পড়ে। কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও। অথচ আখিরাত শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী।” (সূরা আল-আ’লা: ১৬-১৭)
  • ঈমানের দুর্বলতা: জাহান্নামের বর্ণনাকে কেবল একটি তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা এবং হৃদয়ের গভীরে এর ভয়কে স্থান না দেওয়া ঈমানের দুর্বলতার পরিচায়ক।
  • তওবায় দীর্ঘসূত্রতা: “পরে তওবা করব” বা “এখন বয়স আছে”—এই ধরনের মিথ্যা আশা মানুষকে পাপের পথে পরিচালিত করে এবং পরকালের প্রস্তুতি থেকে বিমুখ রাখে।

জাহান্নাম থেকে মুক্তির পথ

কোরআন ও হাদিসে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো:

১. শিরকমুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান: আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক না করা। কারণ শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ, যা আল্লাহ ক্ষমা করেন না। (সূরা আন-নিসা: ৪৮)

২. সালাত প্রতিষ্ঠা: ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে প্রথম পার্থক্যকারী হলো সালাত।”

৩. আন্তরিক তওবা: কৃত পাপের জন্য লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং সেই পাপে পুনরায় লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা।

৪. ফরজ পালন ও হারাম বর্জন: যাকাত, সাওম, হজ্জসহ সব ফরজ বিধান পালন এবং সুদ, ঘুষ, জুলুম, মিথ্যা ও গীবতের মতো হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা।

৫. নিয়মিত দোয়া: রাসূল (সা.) প্রতিটি সালাতের পর জাহান্নামের আগুন থেকে আশ্রয় চেয়ে দোয়া করতেন। আমাদেরও এই সুন্নতের অনুসরণ করা উচিত।

৬. দান-সদকা ও পরোপকার: আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জনসেবামূলক কাজ করা। রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমরা খেজুরের এক টুকরো দিয়ে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো।” (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)

পরিশেষে বলা যায়, জাহান্নাম আল্লাহর ন্যায়বিচারের প্রতীক এবং মানবজাতির জন্য এক চূড়ান্ত সতর্কবার্তা। এর ভয়কে হৃদয়ে ধারণ করে আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলাই হলো একজন মুমিনের প্রকৃত সফলতা।

আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে জাহান্নামের কঠিন আগুন থেকে রক্ষা করে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। আমীন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button