ইসলামে বিবাহ: শুধু চুক্তি নয়, ‘মিসাকান গালিজা’ ও পারস্পরিক সম্মতির বন্ধন
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলাম ধর্মে বিবাহ কেবল একটি সামাজিক প্রথা বা চুক্তি নয়; এটি একটি পবিত্র অঙ্গীকার, যা আল্লাহ তাআলার কাছে ‘মিসাকান গালিজা’ বা অত্যন্ত দৃঢ় চুক্তি হিসেবে বিবেচিত। এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো পারস্পরিক সন্তুষ্টি ও সম্মতি, যা রাযা (رضا) নামে পরিচিত। শরীয়তের দৃষ্টিতে, ভয়, আতঙ্ক বা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া কোনো বিবাহ সম্পূর্ণ হারাম ও অবৈধ।
যখন সম্মতি অনুপস্থিত:
কোনো মেয়েকে দেখতে গিয়ে যদি নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো পরিলক্ষিত হয়, তবে বুঝতে হবে সেখানে ভয় বা মানসিক চাপ (ইকরাহ) কাজ করছে:
১. মেয়েটি চুপচাপ থাকে, কথা বলতে দ্বিধা করে।
২. পরিবারের সদস্যরা তার হয়ে সব কথা বলে দেয়।
৩. মেয়েটির চোখে মুখে ভয় বা অস্থিরতার ছাপ থাকে।
৪. কথা বলার সময় সে চোখ নামিয়ে রাখে বা কাঁপতে থাকে।
ইসলামী পরিভাষায়, ‘ইকরাহ’ (إِكْرَاهٌ) বলতে জোর-জবরদস্তি বা বাধ্য করাকে বোঝায়। ‘ইকরাহ’-এর ভিত্তিতে সম্পন্ন হওয়া বিবাহ শরীয়তের দৃষ্টিতে বাতিল বা ফাসিদ (অবৈধ) হিসেবে গণ্য। এটি কেবল অন্যায় নয়, বরং এক প্রকার জুলুম।
কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা:
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে, তোমরা নারীদের তাদের অনিচ্ছায় (জোর করে) অধিকার করো।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত ১৯)
তাফসিরকারগণ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, যেভাবে জোর করে কারও সম্পদ গ্রহণ করা হারাম, ঠিক তেমনি জোর করে কাউকে বিয়ে দেওয়া বা সম্পর্ক স্থাপন করাও হারাম ও অন্যায়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“অবিবাহিতা নারী তার নিজের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অধিকার রাখে, এবং কুমারী মেয়েকে তার অনুমতি না নিয়ে বিয়ে দেওয়া যাবে না।” (সহিহ মুসলিম ১৪১৯)
অন্য এক হাদিসে আছে: “কোনো বিধবা নারীর অনুমতি ছাড়া তাকে বিয়ে দেওয়া যাবে না, এবং কোনো কুমারী মেয়ের অনুমতি ছাড়া তার বিয়ে দেওয়া যাবে না।” (সহিহ বুখারি ৫১৩৬, সহিহ মুসলিম ১৪১৯)
অনেকে মনে করেন, কুমারী মেয়ে চুপ থাকলে তা সম্মতির লক্ষণ। তবে এটি তখনই প্রযোজ্য যখন এই নীরবতা লজ্জাশীল সম্মতি বোঝায়, ভয় বা জবরদস্তির কারণে নয়। ভয়ের কারণে চুপ থাকা কখনোই সম্মতি হিসেবে বিবেচিত হবে না।
মাযহাবের ইমামগণের ঐকমত্য:
ইসলামী ফিকহের ইমামগণও এই বিষয়ে একমত যে, যদি কোনো নারীকে জোর করে বা ভয় দেখিয়ে বিয়ে দেওয়া হয় এবং তার অন্তরে সম্মতি না থাকে, তবে সেই বিবাহ বাতিল বলে গণ্য হবে। ‘আল-হিদায়া’ গ্রন্থে ‘কিতাবুন-নিকাহ’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে: “যে নারী নিজের সম্মতি দেয়নি, সেই বিয়ে কেবল ইজবার (force) দ্বারা সংঘটিত হলে তা বৈধ নয়।”
জোরপূর্বক বিবাহের ব্যর্থতার কারণ:
বাস্তব অভিজ্ঞতাতেও জোরপূর্বক বিবাহগুলো ব্যর্থতার দিকে ধাবিত হয়:
১. ঘৃণা ও অবিশ্বাস: মেয়ের মনে স্বামীর প্রতি ভয় ও ঘৃণা জন্মে যায়, যা শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
২. মানসিক অশান্তি: ভালোবাসা ও মানসিক শান্তি থাকে না, কারণ সম্পর্ক শুরুই হয় জোরপূর্বক শিকল পরানোর মাধ্যমে।
৩. দূরত্ব বৃদ্ধি: সময়ের সাথে সাথে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাস ও দূরত্ব বাড়ে, যা শেষ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হয়।
৪. অশান্তির ঘর: এমন বিবাহ কেবল বাহ্যিক চুক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকে, অন্তর এক হয় না, ফলে সংসার যন্ত্রণাময় ও অভিশাপের ঘরে পরিণত হয়।
এ ধরনের বিবাহের পরিণতি প্রায়শই ডিভোর্স অথবা চরম গৃহ-অশান্তি। এর ফলে উভয় পরিবারের সামাজিক সম্মানহানি ঘটে।
করণীয় ও ইসলামী নির্দেশনা:
বিবাহের প্রস্তাব দেওয়ার আগে মেয়ের সাথে বিনয়ের সাথে কথা বলা, তার মতামত জানা এবং তাকে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পরিবেশ দেওয়া সুন্নাহর অংশ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যখন তোমরা কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দাও, তখন তার সম্মতি নিশ্চিত করো। কারণ সম্মতি ছাড়া বিয়ে করা অন্যায়।” (আবু দাউদ, নাসাঈ)
অতএব, যদি মেয়েকে ভয় বা চাপের মধ্যে দেখা যায়, তবে সেই প্রস্তাব থেকে সরে আসা উচিত। মেয়ের পরিবারের সাথে বিনয়ীভাবে কথা বলে তার মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করা এবং জোরপূর্বক সম্পর্ক থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। কেননা এতে অন্যের জীবনে পাপের অংশীদার হতে হয়।
ইসলামের উদ্দেশ্য:
ইসলাম এমন বিবাহ চায়, যা দুটি হৃদয়ের মিলনে গঠিত হয়, যেখানে পারস্পরিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও নিরাপত্তা বিদ্যমান। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেছেন:
“তাঁর নিদর্শনগুলোর একটি হলো — তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য জোড়া সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের মাধ্যমে শান্তি পাও।” (সূরা আর-রূম: ২১)
উপসংহার:
ভয়ের পরিবেশে কখনও সত্যিকারের সুখ জন্মায় না। যেখানে ভালোবাসার বীজ জোরের লাঠি দিয়ে রোপণ করা হয়, সেখানে শান্তির ফুল ফোটে না। বিবাহ শুধুমাত্র দুটি দেহের নয়, বরং দুটি মনের, দুটি ‘রাযা’র (সম্মতির) সংযুক্তি। যেখানে ভয় বিদ্যমান, সেখানে আল্লাহ তাআলার রহমত বর্ষিত হয় না।



