
অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি শুধু একজন আইনজীবী, লেখক আর রাজনীতিবিদই ছিলেন না, ছিলেন আপামর বাঙালি জনসাধারণের অধিকার আদায়ের মূর্ত প্রতীক। ‘বাংলার বাঘ’ বা ‘শের-ই-বাংলা’ উপাধি তাঁর অদম্য সাহস আর তেজস্বিতারই পরিচায়ক। তাঁর জীবন ছিল সংগ্রাম, অর্জন আর জনসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
জন্ম ও শৈশব:
১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর (কিছু সূত্রমতে ২৯ অক্টোবর) বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান নেতা। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়। পিতা কাজী মুহাম্মদ ওয়াজেদ ছিলেন বরিশালের একজন স্বনামধন্য আইনজীবী। ফজলুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে, যেখানে তিনি আরবী, ফার্সি ও বাংলা ভাষা আয়ত্ত করেন।
শিক্ষাজীবন: মেধার বিচ্ছুরণ:
মেধাবী ছাত্র ফজলুল হক ১৮৯০ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে প্রথম শ্রেণির বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এফ. এ. পাস করে ১৮৯৪ সালে রসায়ন, পদার্থ ও গণিতে অনার্সসহ বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রে এম. এ. ডিগ্রি এবং ১৮৯৭ সালে কলকাতার ‘ইউনিভার্সিটি ল কলেজ’ থেকে বি. এল. ডিগ্রি লাভ করেন, যা তাঁর কর্মজীবনের ভিত্তি স্থাপন করে।
কর্ম ও পেশাগত জীবন: আইনের পথে জনসেবা:
১৯০০ সালে কলকাতা হাইকোর্টে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহকারী হিসেবে আইন পেশায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। পিতার মৃত্যুর পর তিনি বরিশালে ফিরে এসে আইনচর্চা শুরু করেন। ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দিলেও সরকারের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯১১ সালে চাকরি ত্যাগ করে পুনরায় আইন পেশায় ফিরে আসেন। জনগণের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাই তাঁকে এই পথে নিয়ে আসে।
রাজনৈতিক জীবন: বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা:
স্যার খাজা সলিমুল্লাহ ও নওয়াব নওয়াব আলী চৌধুরীর হাত ধরে ফজলুল হক রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
- মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস: ১৯০৬ সালে ঢাকা নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠায় তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তিনি সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি এবং একই সময়ে (১৯১৬-১৯১৮) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত লীগ-কংগ্রেসের ঐতিহাসিক ‘লক্ষ্ণৌ চুক্তি’ প্রণয়নে তিনি অন্যতম সহায়ক ছিলেন।
- শিক্ষা ও জনকল্যাণ: ১৯২৪ সালে বাংলার শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৩৫-৩৬ সালে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম বাঙালি মুসলমান মেয়র নির্বাচিত হয়ে জনসেবার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।
- কৃষক-প্রজা পার্টি: ১৯২৭ সালে ‘কৃষক-প্রজা পার্টি’ গঠন করে তিনি কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য নিরলস সংগ্রাম করেন, যা তাঁকে সাধারণ মানুষের আরও কাছে নিয়ে আসে।
- অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী: ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময়ে কৃষকদের কল্যাণে তাঁর নেওয়া পদক্ষেপগুলো ছিল যুগান্তকারী।
- লাহোর প্রস্তাব ও ‘শের-ই-বঙ্গাল’ উপাধি: ১৯৪০ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে তিনিই ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাব উত্থাপনের সময় তাঁর ওজস্বিনী বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে পাঞ্জাববাসীরা তাঁকে ‘শের-ই-বঙ্গাল’ বা ‘বাংলার বাঘ’ উপাধি দেন, যা তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।
স্বাধীনতার পর: নবগঠিত রাষ্ট্রের সেবায়:
দেশভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব দিয়ে পূর্ব বাংলার নির্বাচনে জয়লাভ করে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেরও একজন সক্রিয় সমর্থক হিসেবে তিনি বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংগ্রামে অবদান রাখেন।
প্রয়াণ:
এই মহান জননেতা ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উপসংহার:
এ. কে. ফজলুল হক তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে বাঙালি কৃষক ও সাধারণ মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর অসামান্য বাগ্মিতা, নির্ভীক তেজস্বিতা এবং দূরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাঁকে বাংলার ইতিহাসে এক কিংবদন্তী নেতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর আদর্শ আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে।



