বায়াত গ্রহণের গুরুত্ব: ইসলামী দৃষ্টিকোণ
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলামে ‘বায়াত’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আনুগত্য, প্রতিশ্রুতি এবং অঙ্গীকারের প্রতীক। এটি মূলত কোনো নেতা, বিশেষত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে আনুগত্যের শপথ গ্রহণকে বোঝায়। ইসলামী শরীয়তে এর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী, যা কোরআনের আয়াত এবং অসংখ্য হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আমরা বায়াতের গুরুত্ব, এর শর্তাবলী এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে এর প্রয়োগ সম্পর্কে আলোকপাত করব।
বায়াত কী ও কেন?
‘বায়াত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ক্রয়-বিক্রয়, তবে ইসলামী পরিভাষায় এটি নেতা বা আমীরের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করা। এটি এমন একটি চুক্তি যেখানে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) বা তাঁর প্রতিনিধির নির্দেশ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই অঙ্গীকারের মাধ্যমে মুসলমানরা ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনে ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়।
কোরআনের আলোকে বায়াতের গুরুত্ব:
পবিত্র কোরআনে বায়াতের গুরুত্ব একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন:
১. সূরা আল-মুমতাহিনা, আয়াত ১২:
“হে নবী, ঈমানদার নারীগণ যখন তোমার কাছে বাইয়াত গ্রহণের জন্য আসে এবং এ মর্মে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, যিনা করবে না, নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না। সন্তান সম্পর্কে কোনো অপবাদ তৈরি করে আনবে না এবং কোনো ভালো কাজে তোমার অবাধ্য হবে না তাহলে তাদের থেকে বায়াত গ্রহণ করো এবং তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।”
এই আয়াতে মহিলাদের বায়াতের শর্তাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে তাওহীদ (একত্ববাদ), চারিত্রিক পবিত্রতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাসূলের আনুগত্যের মতো মৌলিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত। তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) নারীদের সঙ্গে শারীরিক করমর্দন না করে মৌখিকভাবে বায়াত গ্রহণ করতেন। হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো কোনো বেগানা নারীর হাতে হাত রাখেননি। হযরত উমাইমাহ বিনতে রুকাইকাহ (রা.)-এর হাদিসেও এর সমর্থন পাওয়া যায়, যেখানে রাসূল (সা.) বলেছেন, “আমি বেগানা নারীদের সাথে করমর্দন করি না। আমার একজন নারীকে বলে দেওয়া একশ’ জন নারীর জন্য যথেষ্ট।”
২. সূরা আল-ফাতাহ, আয়াত ১০:
“হে নবী, যারা তোমার হাতে বায়াত করছিল প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহর কাছেই বায়াত করছিল। তাদের হাতের ওপর ছিল আল্লাহর হাত। যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবে তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার অশুভ পরিণাম তার নিজের ওপরেই বর্তাবে। আর যে আল্লাহর সাথে কৃত এ প্রতিশ্রুতি পালন করবে, আল্লাহ অচিরেই তাকে বড় পুরস্কার দান করবেন।”
এই আয়াতে বায়াতকে সরাসরি আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বায়াতের পবিত্রতা ও গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। বায়াত ভঙ্গ করাকে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গের সমতুল্য মনে করা হয়েছে, যার পরিণতি গুরুতর।
৩. সূরা আল-ফাতাহ, আয়াত ১৮:
“আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা গাছের নিচে তোমার কাছে বায়াত করছিল। তিনি তাদের মনের অবস্থা জানতেন। তাই তিনি তাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল করেছেন, পুরস্কারস্বরূপ তাদেরকে আশু বিজয় দান করেছেন।”
এই আয়াতে হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় গাছের নিচে সাহাবিদের বায়াত (বায়াতুর রিদওয়ান) এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই বায়াতের মাধ্যমে মু’মিনদের দৃঢ় ঈমান ও নিষ্ঠার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রকাশ পেয়েছে এবং তাদের জন্য দ্রুত বিজয়ের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।
হাদিসের আলোকে বায়াতের শর্ত ও প্রকারভেদ:
বিভিন্ন হাদিসে বায়াতের বিস্তারিত শর্ত ও প্রকারভেদ বর্ণিত হয়েছে:
১. আনুগত্য ও সত্যের ওপর অবিচল থাকা:
উবাদা ইব্ন সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নিকট শপথ করলাম, তাঁর কথা শ্রবণ করা এবং আনুগত্য করার উপর প্রত্যেক অনুকূল এবং প্রতিকূল অবস্থায় এবং সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায়। আর ক্ষমতার ব্যাপারে যথোপযুক্ত লোকের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হবো না। আর যেখানেই থাকি না কেন, আমরা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবো এবং আমরা কোনো নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করবো না।” (সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪১৪৯)
২. শাহাদাত বা মৃত্যুর ওপর বায়াত:
ইয়াযীদ ইব্ন আবূ উবায়দ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সালামা ইব্ন আকওয়া (রা.)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা হুদায়বিয়ার দিনে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নিকট কোন কথার উপর বায়াত গ্রহণ করেছিলেন? তিনি বলেন: “মৃত্যুর উপর।” (সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪১৫৯)
৩. জিহাদের উপর বায়াত:
ইয়ালা ইব্ন উমাইয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “মক্কা বিজয়ের দিন আমি আমার পিতা উমাইয়াকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নিকট নিয়ে আসলাম এবং বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আমার পিতা থেকে হিজরত করার উপর বায়াত গ্রহণ করুন। তিনি বললেন: ‘আমি তার থেকে জিহাদ করার বায়াত নেব। কারণ হিজরত শেষ হয়ে গেছে।'” (সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪১৬০)
৪. মৌলিক পাপ থেকে বিরত থাকার বায়াত:
উবাদা ইব্ন সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সাহাবা বেষ্টিত অবস্থায় বললেন: তোমরা আমার নিকট এ কথার উপর বায়াত কর যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যাভিচার করবে না, স্বীয় সন্তানদের হত্যা করবে না। আর তোমরা কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেবে না এবং ন্যায় কাজে আমার অবাধ্যতা প্রকাশ করবে না; যে ব্যক্তি এরূপ বায়াত পূর্ণ করবে, তার সওয়াব আল্লাহর যিম্মায়, আর যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে কোনো অপরাধ করবে, তারপর শাস্তি ভোগ করবে, তা তার জন্য কাফফারা হয়ে যাবে। আর কেউ যদি কোনো অপরাধ করে এবং আল্লাহ্ তা‘আলা তা ঢেকে রাখেন, তার ব্যাপার আল্লাহর ইচ্ছাধীন। যদি তিনি ইচ্ছে করেন, তবে তাকে ক্ষমাও করতে পারেন, আর ইচ্ছা করলে শাস্তিও দিতে পারেন।” (সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪১৬১)
৫. কল্যাণকামিতা ও ইবাদতের উপর বায়াত:
জারীর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললাম: ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আমি আমার পছন্দনীয় এবং অপছন্দনীয় সকল প্রকার কাজের ব্যাপারে আপনার কথা শ্রবণের এবং আপনার অনুসরণ করার বায়াত গ্রহণ করেছি। তিনি বললেন: ‘হে জারীর! তোমার কি সেই ক্ষমতা আছে কিংবা তুমি কি তা পারবে?’ বরং তুমি বল, আমার দ্বারা যতটুকু সম্ভব। তারপর তিনি এরপর আমার নিকট হতে বায়াত করলেন। আমি আরও বায়াত গ্রহণ করলাম প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি কল্যাণকামিতার।” (সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪১৭৪)
অন্য এক হাদিসে জারীর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নিকট তখন উপস্থিত হই, যখন তিনি বায়াত গ্রহণ করেছিলেন। আমি বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আপনার হাত বাড়িয়ে দিন, যাতে আমিও আপনার নিকট বায়াত গ্রহণ করতে পারি। আর আপনি যা ইচ্ছা আমার উপর শর্ত করুন এবং এ সম্পর্কে আপনি ভাল জানেন। তিনি বললেন: ‘আমি এই শর্তে তোমার বায়াত গ্রহণ করছি যে, তুমি এক আল্লাহর ইবাদত করবে, সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে, মুসলমানদের শুভাকাঙ্ক্ষী থাকবে এবং মুশরিকদের পরিত্যাগ করবে।'” (সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪১৭৭)
বায়াত ইসলামের একটি গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, যা একজন মুসলমানের ঈমান ও অঙ্গীকারের প্রতিচ্ছবি। এটি কেবল একটি মৌখিক বা প্রতীকী বিষয় নয়, বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য এবং ইসলামী জীবনযাপনের এক সুদৃঢ় শপথ। বায়াতের মাধ্যমে মুসলমানরা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার এবং সৎ কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এই অঙ্গীকারের পূর্ণতা ইহকালীন সাফল্য এবং পরকালীন মুক্তির সোপান



