ইসলাম কি সত্য ধর্ম? অমুসলিমদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে বিতর্কের নিরসন
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: “যদি ইসলাম সত্য ধর্ম হয়, তাহলে অমুসলিমরা সংখ্যায় বেশি কেন?” – এই প্রশ্নটি বিভিন্ন মহলে প্রায়শই আলোচিত হয়। পৃথিবীতে ইসলামের অনুসারীর সংখ্যা একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলেও, এটি সংখ্যাগুরু ধর্ম নয়। তবে সংখ্যার এই তারতম্য কি কোনো ধর্মের সত্যতা নিরূপণের মাপকাঠি হতে পারে? কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে এই প্রশ্নের একটি যুক্তিসঙ্গত ও সহানুভূতিশীল ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো।
১. সংখ্যাই সত্যের মাপকাঠি নয়
কোরআন স্পষ্টভাবে সতর্ক করে যে সংখ্যার আনুগত্য অনেক সময় মানুষকে ভ্রান্ত পথে নিয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন: “যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কথা অনুসরণ করো, তারা তোমাকে আল্লাহর পথে থেকে ভ্রষ্ট করবে।” (সূরা আল-আনʻām)। এর অর্থ হলো, জনপ্রিয় বা প্রচলিত পথ সবসময় সঠিক পথ নাও হতে পারে। বরং সত্য হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান ও হেদায়েত, যা সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল নয়।
২. ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত প্রভাব
মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস প্রায়শই ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব, আবেগ, পারিবারিক শিক্ষা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং শাসন ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি অঞ্চলে যে ধর্ম প্রচলিত, তা সে অঞ্চলের ইতিহাস, বাণিজ্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ফল। তাই ধর্মীয় সংখ্যাগত বিভাজন কোনো ধর্মের সত্যতা বা মিথ্যাত্ব নির্ধারণ করে না; এটি কেবল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের একটি ফলাফল।
৩. হেদায়েত আল্লাহর ইচ্ছাধীন, মানবজাতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে
ইসলামী দর্শনে হেদায়েত (সঠিক পথ প্রদর্শন) মানুষের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার পাশাপাশি আল্লাহর রহমত ও ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। কোরআন বারবার মানুষকে আহ্বান জানিয়েছে সঠিক পথে আসার জন্য। তবে, যদি হৃদয় উন্মোচিত না হয় বা আল্লাহ ইচ্ছা না করেন, তবে মানুষ সত্য উপলব্ধি করতে পারে না। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ প্রজ্ঞা (সত্য) অর্জনে সক্ষম হয় না। তাই, অনুসারীর সংখ্যা কম থাকা হেদায়েতের অনুপস্থিতি নয়, বরং আল্লাহর অসীম প্রজ্ঞা ও ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ।
৪. পরীক্ষা এবং দায়বদ্ধতা
কোনো যুগে অনুসারীর সংখ্যা বেশি হলেও তা আসলে দায়বদ্ধতা বাড়ায়। কোরআনে বলা হয়েছে, মানুষের কাছে নবী-রাসূল পাঠানোই একটি পরীক্ষা—কেউ তা গ্রহণ করবে, কেউ প্রত্যাখ্যান করবে। সংখ্যার ভিত্তিতে ‘সত্য’ প্রমাণের চেষ্টা এমন পরীক্ষারই একটি অংশ হতে পারে। তবে, গভীর বিশ্বাস থাকলে সংখ্যার চিন্তা গৌণ হয়ে পড়ে এবং নৈতিকতা ও দ্বীনি সত্যই মূখ্য হয়ে ওঠে।
৫. আল্লাহর রহমত প্রত্যক্ষভাবে দেখা যায় না
আল্লাহ সরাসরি দৃশ্যমান উপায়ে হেদায়েত দেন না। তাঁর বাণী, নবীদের শিক্ষা এবং সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহের মাধ্যমেই মানুষকে আহ্বান জানানো হয়। অনেকে পার্থিব সহায়-সম্পদের জন্য প্রচলিত অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে, আবার অনেকে খোলামেলা হৃদয়ের কারণে ঈমান গ্রহণ করে। তাই, সংখ্যায় কম হওয়া হেদায়েতের অনুপস্থিতি নয়; এটি মানবতা এবং আল্লাহর রহমতের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল।
৬. ধর্মীয় পরিবর্তন ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মানুষের বিশ্বাস পরিবর্তিত হয়েছে। পূর্বে প্রচলিত ধর্মের পরিবর্তে নতুন বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোরআন ও দাওয়াহ (ইসলামের পথে আহ্বান) কাজের মাধ্যমে আজও মানুষের মন পরিবর্তন সম্ভব। তাই, সংখ্যার আধিপত্যকে চূড়ান্ত বলে মনে করা ঠিক নয়; হৃদয়ের পরিবর্তনের সুযোগ সর্বদা উন্মুক্ত।
৭. সওয়াব ও দায়িত্ব: সংখ্যায় নয়, নেক আমলে
ইসলাম শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর কাছে মর্যাদা তাকওয়া বা খোদাভীতির ওপর নির্ভরশীল, সংখ্যায় নয়। তাই মুসলিমদের দায়িত্ব হলো শিষ্টাচার, সৎকর্ম, সদাচার এবং আল্লাহর নির্দেশাবলী প্রচার করা, যা প্রকৃত দাওয়াহর মূল ভিত্তি।
কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর:
- মানুষকে কীভাবে হেদায়েত করব?
নম্রতা ও উদ্যোগের সাথে দাওয়াহ দিন—ভালো আচরণ, স্পষ্ট বর্ণনা এবং প্রমাণসহ কথা বলুন। কোরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী দাওয়াহ সবচেয়ে কার্যকর। - সংখ্যায় কম হওয়া কি মুসলিমদের জন্য ভর্ৎসনা?
না, এটি বরং একটি মহান দায়িত্ব ও অনুপ্রেরণা। সংখ্যায় কম হলেও সত্যকে মেনে চলা এবং সৎকর্ম করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ প্রতিটি মুমিনকে উত্তম কাজে উৎসাহিত করেন। - অন্যদের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক রাখব?
সদয় হোন, কাউকে অবজ্ঞা করবেন না। জ্ঞান ও সতর্কতার সাথে আল্লাহর কথা বলুন। নম্রতা ও দয়া দাওয়াহর সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।
উপসংহার:
সংখ্যা কোনো ধর্মকে সত্য বা মিথ্যা প্রমাণ করে না। ইসলাম দাওয়াহ, তাওবা এবং শান্তিপূর্ণ আহ্বানের ধর্ম। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দান করেন—এটা তাঁর অসীম রহমত ও ইচ্ছার বিষয়। আমাদের কাজ হলো যথাযথভাবে, নম্রভাবে, প্রমাণ ও ভালোর পথে মানুষের পাশে থেকে দাওয়াহ দান করা।



