দেশপ্রশাসনবাংলাদেশমতামতসংগৃহীত সংবাদসম্পাদকীয়

১৪ বছরের মেহেদি: মায়ের হাতে শেষ রসুনভর্তা খেয়েছিল, ঢামেকে চিকিৎসা দিতে ‘উপরের নির্দেশ’ মানা হয়নি

অনলাইন ডেস্ক: গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) সংলগ্ন চানখারপুল এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয় ১৪ বছর বয়সী শেখ মেহেদি হাসান জুনায়েদ। তার ডাকনাম মোস্তাকিম। গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হলেও এক চরম অমানবিক দৃশ্যের অবতারণা হয়। কর্তব্যরত কর্মকর্তারা তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।

দায়িত্বরত কর্তারা সেই মুহূর্তে তার স্বজনদের বলেছিলেন, “উপর থেকে নির্দেশ দিয়েছে চিকিৎসার জন্য কাউকে রিসিভ করা যাবে না। অন্য কোথাও নিয়ে যান, নাহয় লাশের সাথে মর্গে ফেলে রাখেন, পরিবার আইস্যা খুঁজে নিয়ে যাবে।” পরে সেখান থেকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ততক্ষণে তার নিথর দেহ শহীদের খাতায় নাম লেখায়।

রসুনভর্তা আর লুকানো আন্দোলন

শাহাদাত লাভের দিন ভোরে মেহেদি তার মায়ের সাথে শেষবারের মতো কিছু মুহূর্ত কাটায়। ৫ আগস্ট ভোরে ফজর নামাজ শেষে মা কোরআন শরীফ পড়ছিলেন, তখন তিনি ড্রয়িংরুমে টিভির শব্দ শুনতে পান। গিয়ে দেখেন, মেহেদি বিভিন্ন চ্যানেলে সংবাদ দেখছে। মা তাকে আরও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে বললেও সে রাজি হয়নি।

কিছুক্ষণ পর বাবা বাইরে থেকে নাস্তা আনতে বললে মেহেদি জানায়, সে সকালে নাস্তা করবে না, বরং তার মায়ের হাতের অত্যন্ত পছন্দের রসুনভর্তা দিয়ে ভাত খাবে। ডিম ভেজে দেওয়ার প্রস্তাবও সে ফিরিয়ে দেয়। মায়ের হাতে ভাত খেতে খেতেই মেহেদি জানায়, সে মাকে না জানিয়ে লুকিয়ে দু’দিন আন্দোলনে গিয়েছিল এবং রাস্তায় ভাইয়াদের পানি-বিস্কুট খাইয়েছে।

ছেলে মাকে বোঝায়, তাদের বয়সী কতজন রাস্তায় নামছে, মার খাচ্ছে; এমনকি প্রতিবন্ধী ছেলেরাও আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। বড় ভাইয়ারা তাদের সবার অধিকারের জন্য জীবন দিচ্ছে, তাই ঘরে বসে থাকা যায় না। ছেলের কথায় মন গলে গিয়ে মা তখন বড় বোনসহ সবাই মিলে একসাথে বের হওয়ার পরিকল্পনা করেন।

বাবার বারণ, মায়ের সংকল্প এবং মর্মান্তিক বিচ্ছেদ

মেহেদির মা-বোন রেডি হওয়ার সময় বাবা বকাঝকা করতে থাকেন এবং পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে জানিয়ে বাইরে যেতে মানা করেন। মেহেদির মা তখন সংকল্পের সুরে বলেন, “আল্লাহ কপালে যা রাখছে তা-ই হবে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা মার খাবে, আমরা ঘরে বসে থাকব কিভাবে!”

মেহেদি মাকে বলে, সে বন্ধুর সাথে আসবে। মা-বোন মতিঝিল আইডিয়াল কলেজের দিকে রওনা দেন, কারণ মেহেদি প্রতিদিনের অভ্যাস অনুযায়ী হয়তো বন্ধুর সাথে খেলতে চলে গেছে ভেবে তারা আর দেরি করেননি। এদিকে মেহেদি তার বন্ধুর সাথে চাঁনখারপুল আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনে চলে যায়।

আন্দোলনের পথে পুলিশ যখন মায়ের কাছে জানতে চাইছিল, কোথায় যাচ্ছেন, তখন তিনি প্রতিবারই উত্তর দেন, “লাশ দেখতে যাচ্ছি। আমার নিকটাত্মীয় একজনের লাশ।” তখনও তিনি জানতেন না, কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের সন্তানের লাশ দেখতে হবে তাকে।

শেষ মুহূর্তের প্রত্যয় ও শাহাদাত

চাঁনখারপুলে প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টা পুলিশি হামলার বিরুদ্ধে ইটপাটকেল ছুঁড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে মেহেদি ও তার বন্ধুরা। বেলা আনুমানিক দেড়টার দিকে পুলিশ পিছিয়ে গেলে পাশে থাকা গলির মুখে কিছু পুলিশ অবস্থান নেয়। এক বন্ধুর সাথে মেহেদি যখন মাথা নিচু করে ইটের টুকরো হাতে নিতে যাবে, ঠিক তখনই পরপর দুটি গুলি তার মাথায় আঘাত করে। একটি গুলি একপাশ দিয়ে ঢুকে ছিদ্র করে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে যায় এবং অন্য একটি গুলি তার চোখ দিয়ে ঢুকে ভেতরে আটকে যায়।

এর কিছুক্ষণ আগে এক বন্ধু তাকে বাসায় ফিরে যেতে বললে ১৪ বছর বয়সী মেহেদি প্রত্যয়ের সাথে উত্তর দেয়: “তুই যাইলে যা, আমি যাব না। হয় শহীদ হয়ে ঘরে ফিরব, না হয় তার পতন (হাসিনার) শেষে বীরের বেশে ঘরে ফিরব।”

মায়ের আর্তনাদ: “আমার বুকটা ধুকধুক করছে”

আইডিয়াল কলেজের সামনে মা-মেয়ের এক-দেড় ঘণ্টা কেটে যায়। রোজার কারণে শরীর খারাপ লাগছে কিনা জানতে চাইলে মা উত্তর দেন, “না রে। আমার বুকটা ধুকধুক করছে। ভালো লাগতেছে না। এটা রোজা রাখার জন্য না। আমার মেহেদির কিছু হলো কিনা, আল্লাহ মাবুদ জানে।”

এরপর মায়ের ব্যাগে রাখা স্মার্টফোনটি বের করে দেখা যায়, তার বাপের বাড়ির আত্নীয়স্বজনের ১৫-১৬টি মিসড কল। বড় ভাই কল রিসিভ করতেই জিজ্ঞাসা করেন, “মোস্তাকিম কই?” এরপর বিভিন্ন জায়গা থেকে আঘাত পাওয়ার খবর আসে। ততক্ষণে মায়ের মন তাকে জানিয়ে দেয়, তার কলিজার টুকরার কিছু একটা হয়ে গেছে।

বাসার কাছাকাছি এসে তিনি দেখতে পান, তাদের পুকুরপাড়ে শত শত মানুষের ভিড়, চলছে কান্নাকাটি। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে তিনি তার ছেলের নিথর দেহ দেখতে পান। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে মুহূর্তেই তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন।

প্রকৌশলী ও হাফেজ হওয়ার স্বপ্ন

উইল ফাওয়ার স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত মেহেদি। তার স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পাশাপাশি কুরআনের হাফেজ হবে। এ জন্য সে হাফেজি মাদ্রাসায় ভর্তিও হয়েছিল এবং প্রায় দশ পারার মতো মুখস্থ করে ফেলেছিল।

বাবা-মায়ের কাছে মেহেদির একটি কথা আজও কানে বাজে, “আম্মু দেখবা, আব্বু এখন আমাদের বকাঝকা করে। একদিন দেখবা আমাদের দুই ভাই-বোনকে নিয়ে তোমরা গর্ববোধ করবা।” তার মা হাসতে হাসতে বলতেন, “তোমার আপুকে নিয়ে নাহয় আশা করা যায়, কিন্তু তুমি এমন কী করবা?” মেহেদি তখন বলেছিল, “আরে দেইখো, এখন নাহয় কিছু করতে পারি নাই। একদিন দেখবা আমাকে নিয়েই বেশি গর্ববোধ করবা।”

আজ তার মা জানান, মেহেদির জানাজায় এত মানুষ হয়েছিল যে কেন্দ্রীয় ঈদের জামাতেও এত মানুষ হয়নি কখনো। সন্তানের শোকে আড়াই মাস ধরে তার ঠিক মতো ঘুম নেই। রাতে ঘুম ভেঙে যায়। ছেলের কথা মনে পড়লে কাঁদতে থাকেন। ছেলের প্রিয় রসুনভর্তা তৈরি করে রাখেন, কিন্তু তার মোস্তাকিম আর খেতে আসে না। তার বিড়ালগুলো আজও তাকে খোঁজে, তার ছবির পোস্টারের ওপর শুয়ে থাকে।

ছেলেটির রক্তেই নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। তার মা-বাবার জন্য এটি আজ পরম গৌরবের বিষয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button