
নিজস্ব প্রতিবেদক: কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে দুর্নীতির মহোৎসব ইঞ্জিনিয়ারদের গাফিলতি, অনিয়ম আর দলীয় প্রভাবেই চলছে ‘অবৈধ উন্নয়ন’
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে যেন এখন অবৈধ কাজও বৈধ! অনুমোদনবিহীন ভবন নির্মাণ, খাসজমি দখল, ইঞ্জিনিয়ারদের গাফিলতি আর দলীয় প্রভাব সব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে দুর্নীতির এক বিশাল সাম্রাজ্য। সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোটি টাকার বহুতল ভবন নির্মাণে জড়িত কিছু অসাধু ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে উঠেছে গুরুতর অভিযোগ।
আশকতলা, বাগিচাগাঁও, নতুন চৌধুরীপাড়া ও আশপাশের এলাকায় একের পর এক ভবন নির্মাণ চলছে বিনা অনুমতিতে।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, চারতলা ভবন নির্মাণের জন্য রাস্তার প্রস্থ হতে হয় অন্তত ১৫ ফিট। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে—১৫ ফিটেরও কম রাস্তায় সাততলা ভবন গড়ে উঠছে কোনো বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই।
সংবাদকর্মীরা অনুমোদনের নথি চাইলে সিটি কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়াররা নথি দেখাতে ব্যর্থ হন। বরং অনেকেই সাংবাদিকদের বলেন,“আমরা প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নই।”
২০২৫ সালের ৭ আগস্ট ইঞ্জিনিয়ার মাকসুদকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি প্রথমে জানান, আমি বিকেলে লোক পাঠাব।
কিছুক্ষণ পর আবার বলেন, “আমি অনুমোদন দিইনি, শাহিন স্যার দিয়েছেন।”
পরের দিন একই প্রশ্নে নতুন উত্তর—“এটা সালাম স্যার করিয়েছেন।”
তিন ইঞ্জিনিয়ারের তিন রকম বক্তব্য—দায় এড়াতে চলছে দোষ চাপানোর খেলা!
বাড়ি নির্মাণের কাজে সরকারি রাস্তা দখল করে রাখা হচ্ছে ইট-বালি-পাথরে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, ভাঙছে রাস্তা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলে ঠিকাদাররা “বিএনপি নেতা” পরিচয় দিয়ে হুমকি দেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে—তারা রাজনৈতিক দলের কেউ নন; বরং প্রভাবশালী ইঞ্জিনিয়ারদের ছত্রছায়ায় থাকা ঠিকাদার চক্রের সদস্য।
ইঞ্জিনিয়ারদের তথ্যমতে, তিন বছরের মধ্যে ভবনের কাজ শুরু না হলে অনুমোদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়। তবুও আশকতলা ও বাগিচাগাঁও এলাকায় ২০২৩ সালে বাতিল হওয়া অনুমোদনের ভবনগুলোতে এখনো বহুতল নির্মাণ চলছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে নেই ফায়ার সার্ভিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড বা সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনপত্র। অথচ ইঞ্জিনিয়ার অফিসের চেয়ারে বসেই “নির্মাণ অনুমতি” দিচ্ছেন বলে অভিযোগ।
শুধু ভবন নয় রাস্তা, ড্রেন ও পানি নিষ্কাশনসহ প্রায় সব উন্নয়ন কাজেই চলছে অনিয়ম। রাস্তা নির্মাণে মানহীন বালি ব্যবহার করা হচ্ছে; পাথর বা কঙ্কর প্রায় অনুপস্থিত। পুরনো রাস্তা খুঁড়ে নতুন রাস্তা দেখিয়ে বিল উত্তোলনের অভিযোগও রয়েছে।
শহরের বিভিন্ন এলাকায় ড্রেন বন্ধ ও নোংরা থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিসিক শিল্পাঞ্চল এলাকায় অবস্থা আরও করুণ—ভাঙা রাস্তা, পচা পানির দুর্গন্ধ আর নোংরা পরিবেশ যেন সেখানে নিত্যদিনের দৃশ্য।
বিসিক শিল্পাঞ্চলে রাস্তা-ড্রেনবিহীন এলাকায় চলছে খাদ্য উৎপাদন। প্রশাসনের ভাষায়, বিসিক এলাকা সিটি কর্পোরেশনের আওতায় নয়।”
তবুও এখান থেকেই শহরে প্রতিদিন যাচ্ছে খাদ্যপণ্য! প্রশ্ন জাগে—এই খাদ্য কতটা নিরাপদ? যেখানে ম্যাজিস্ট্রেটরা অস্বাস্থ্যকর খাবারের দোকানে অভিযান চালান, সেখানে বিসিক এলাকায় দূষিত পরিবেশে খাদ্য উৎপাদন—এ কেমন দ্বৈত নীতি?
সরকারি কর্মকর্তারা যেখানে ইচ্ছেমতো আইন ভাঙছেন, সেখানে সাধারণ নাগরিকের সামান্য ভুলেই জরিমানা বা মামলা। তাহলে প্রশ্ন ওঠে—এই নিয়ম কি শুধু জনগণের জন্য, নাকি দুর্নীতিবাজদের আড়াল করার জন্য?
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে ড্রেন পরিষ্কার—সবখানেই চলছে অনিয়ম ও দুর্নীতির উৎসব। সরকারের অর্থে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানের ইঞ্জিনিয়ারদের জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য মাননীয় জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের জরুরি হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ইট, পাথর আর রাস্তার ধুলো যেন এখন দুর্নীতির সাক্ষী। সরকারের কঠোর নজরদারি না বাড়লে “অবৈধতাই বৈধতা” হয়ে উঠবে কুমিল্লা নগরীর নতুন বাস্তবতা।



