দেশবাংলাদেশবিশ্লেষণসংগৃহীত সংবাদ

জুলাই সনদের মোড়কে ’৭২-এর প্রেতাত্মা: প্রতারণার নতুন ফাঁদ—অধ্যাপক এম এ বার্ণিক এর বিশ্লেষণ

অধ্যাপক এম এ বার্ণিক: গত অক্টোবর (২০২৫) মাসে ঘোষিত ‘জুলাই সনদ’কে ‘গণঅভ্যুত্থানের রূপায়ণ’ হিসেবে জাতির সামনে হাজির করা হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, এটিই নাকি জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার একমাত্র নথি।

কিন্তু অধ্যাপক এম এ বার্ণিকের বিশ্লেষণ বলছে, গভীর পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এই সনদটি আসলে ১৯৭২ সালের সংবিধানের কঠোর কাঠামোকে কেবল ঘষামাজা করে নতুন মোড়কে পুনঃপ্রবর্তনের একটি চতুর কৌশল। এর মূল লক্ষ্য জনগণের মুক্তি নয়, বরং পুরনো ক্ষমতাব্যবস্থার পুনর্বাসন।

‘১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃস্থাপন’ রাজনৈতিকভাবে শুনতে মোহনীয় হলেও ইতিহাস সাক্ষী, সেই সংবিধানেই একদলীয় শাসনের বীজ নিহিত ছিল, যা ১৯৭৫ সালের ফ্যাসিস্ট ‘বাকশাল’-এর জন্ম দিয়েছিল। জুলাই সনদ সেই কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে তার উপর কিছু ‘গণতান্ত্রিক রঙ’ চাপিয়েছে। এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার— জনগণকে নতুন আলোর ফ্রেমে পুরনো ব্যবস্থায় বন্দি করা।

বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জনগণের সার্বভৌমত্ব যদি সত্যিই প্রতিষ্ঠা পেত, তবে নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্রপতি নিয়োগের মতো মৌলিক বিষয়গুলো জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হতো। অথচ সনদে এর বাস্তব কোনো রূপরেখা নেই।

জুলাই সনদের অন্যতম দুর্বল অংশ হলো নির্বাচন কমিশন সম্পর্কিত অধ্যায়টি। এখানে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন, নিয়োগ পদ্ধতি বা জবাবদিহি নিশ্চিত করার কোনো নতুন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়নি। বরং ‘গণভোট’ আয়োজনের নামে কৌশলে আবারও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বহাল রাখার পথ রাখা হয়েছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন যদি জনগণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, তবে গণভোটের আয়োজনও কেবল একটি ‘রাষ্ট্রনাট্য’ মাত্র।

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের ভিত্তি ছিল জনগণের রক্ত, শহীদের আত্মত্যাগ এবং ফ্যাসিবাদের পতন। কিন্তু ২০২৫ সালের ‘জুলাই সনদ’ সেই ইতিহাসকেই সযত্নে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। তারিখের বিকৃতিই এর প্রমাণ: গণঅভ্যুত্থান হয়েছে ২০২৪ সালে, অথচ সনদের নাম রাখা হয়েছে ‘জুলাই সনদ ২০২৫’! যারা এভাবে তারিখ পাল্টেছেন, তারা আসলে ২০২৪ সালের অস্তিত্ব বিলীন করতে চাইছেন।

এই সনদটি যদি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ফিরে আসার পথ বন্ধ করতে না পারে, কিংবা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি ‘চুপ্পু’ আজও বহাল থাকেন, তাহলে একে ‘বিপ্লবের সনদ’ বলা যায় কীভাবে? জনআকাঙ্ক্ষা ছিল, সনদ স্বাক্ষরের সঙ্গেই রাষ্ট্রপতি ‘চুপ্পু’-এর স্বয়ংক্রিয় অপসারণ ঘটুক— যা ঘটেনি। অতএব, এটি প্রকৃত ‘জুলাই সনদ’ নয়, বরং জুলাই চেতনার প্রতি সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা।

যারা জীবন দিয়ে ফ্যাসিবাদ ঠেকিয়েছিলেন, সেই তরুণ ‘জুলাই যোদ্ধারা’ প্রত্যেকেই ‘জাতীয় বীর’ উপাধির দাবিদার। কিন্তু সনদে ‘জুলাইযোদ্ধা’ বা শহীদদের প্রতি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিধান রাখা হয়নি। এমনকি আন্দোলনের মূল বছর—২০২৪—কেও উপেক্ষা করা হয়েছে। এটি কার্যত জুলাই যোদ্ধাদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণা না করারই অঙ্গীকারনামা।

অধ্যাপক বার্ণিকের মতে, জুলাই সনদ কোনো গণতান্ত্রিক দলিল নয়; এটি স্রেফ ‘রাজনৈতিক পুনর্বাসনের একটি চাল’। সনদের মূল লক্ষ্য জনগণের সার্বভৌমত্ব নয়, বরং একটি ‘ক্ষমতাকেন্দ্রিক সামঞ্জস্য’ বজায় রাখা:

  • রাষ্ট্রপতি পদে স্থিতাবস্থা।
  • নির্বাচন কমিশন প্রশাসনের অধীনে।
  • বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নীরবতায় ঢাকা।
  • গণঅভ্যুত্থানের বছর ইতিহাস থেকে বাদ।

এই সনদ যদি সত্যিই জনগণের সনদ হতো, তবে তা শহীদের রক্তে স্বাক্ষরিত হতো। কিন্তু এটি স্বাক্ষরিত হয়েছে রাজনৈতিক মঞ্চে, জনগণের অন্ধকারে। যে সনদ ফ্যাসিবাদকে রুখতে পারেনি, রাষ্ট্রপতিকে সরায়নি, ইতিহাস বদলে দিয়েছে, এবং শহীদদের সম্মান দেয়নি— এটি ‘জাতীয় সনদ’ নয়, জাতিকে দেওয়া এক নতুন প্রতারণা এবং জুলাই চেতনার অস্বীকৃতিপত্র।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button