অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: দীর্ঘ ৫ বছরের বেশি সময় ধরে নিয়মিত কমিটি ছাড়াই চলছে রাজধানীর অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। এই সুযোগে উন্নয়নের নামে চলছে ব্যাপক আর্থিক লুটপাট ও অনিয়ম। পরিদর্শক ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই প্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ দুর্নীতিচিত্র। মাত্র ২ মাসের মধ্যে সাড়ে চার কোটি টাকারও বেশি উন্নয়ন ব্যয় দেখানো হয়েছে, যার মধ্যে শ্রমিকের বিলই ২ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এমনকি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তির প্রতিও চরম উদাসীনতা দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কেনা বাস বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, অথচ প্রধান শিক্ষকের বিলাসবহুল গাড়িটি বহাল তবিয়তে চলছে।
ডিআইএ-এর তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, মনিপুর স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ মাত্র ২ মাসের ব্যবধানে ৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা উন্নয়ন খাতে ব্যয় করেছে। গুরুতর অভিযোগ হলো—এই বিপুল ব্যয়ের জন্য পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি এবং প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের নিয়ম মানা হয়নি, যা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) পরিপন্থী।
দেখা গেছে, এই কাজে শুধু শ্রমিক বিল দেখানো হয়েছে ২ কোটি টাকারও বেশি। নির্দিষ্টভাবে ৩ কোটি ১২ লাখ টাকার বিল পরিশোধের সময় ৪০ লাখ টাকার বেশি আয়কর ও ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
নিয়ম লঙ্ঘন করে এডহক কমিটি উন্নয়ন কাজের কার্যাদেশ দেওয়ায় মেসার্স শিলা এন্টারপ্রাইজকে রাজমিস্ত্রি, কাঠ ও স্যানিটারি শ্রমিক বাবদ ৬১ লাখ টাকা দেওয়া হয়। বান্না এন্টারপ্রাইজ রংয়ের কাজ বাবদ শ্রমিক বিল দিয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এছাড়া, তানভীর এন্টারপ্রাইজ টাইলস, মোজাইক ও ইলেকট্রিক শ্রমিক বাবদ খরচ করেছে ১৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা এবং মেসার্স মোল্লা ওয়েল্ড গ্রিল, অভিভাবক শেড তৈরির জন্য শুধু শ্রমিক খরচ হিসেবেই নিয়েছে ১২ লাখ টাকা। পিপিআর অনুযায়ী, ছয় লাখ টাকার বেশি মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে পত্রিকায় দরপত্র আহ্বান করা বাধ্যতামূলক।
অর্থ আত্মসাতের আরেকটি বড় খাত হিসেবে উঠে এসেছে ম্যাগাজিনের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায়। ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রতি বছর শুরুতে ২০০ টাকা করে ম্যাগাজিন বাবদ নেওয়া হয়। এ বাবদ প্রতিষ্ঠানটি বছরে অন্তত ৫৩ লাখ টাকা আদায় করে। বিস্ময়কর তথ্য হলো—২০১৩ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত এক যুগেও কোনো ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়নি। অর্থাৎ বিগত ১২ বছরে এই খাত থেকে শিক্ষার্থীদের ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশি অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাস বিক্রি, হ্যারিয়ার বহাল: শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য চারটি বাস বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে হাজারো শিক্ষার্থী পরিবহন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কর্তৃপক্ষ করোনাকালীন যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার অজুহাত দিলেও, একই সময়ে প্রধান শিক্ষকের জন্য হ্যারিয়ার গাড়িটি (এবং দাপ্তরিক কাজের জন্য দুটি মাইক্রোবাস) রেখে বাকি চারটি বাস বিক্রি করা হয়।
চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের অবৈধ পুনর্বহাল: আর্থিক দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও কোচিং বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগে এক যুগ আগে নির্বাচিত কমিটি কর্তৃক যেসব শিক্ষক-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, তাদের অনেককেই বিধি বহির্ভূতভাবে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। বরখাস্তকৃত পাঁচ শিক্ষককে (মোহাম্মদ বাদশা রমিজ উদ্দিন, দুরুল হুদা, মো. জাকির হোসেন, মো. মফিজুর রহমান, এসএম লিয়াকত আলী) নিয়ম উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্ট থেকে ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। যদিও কর্তৃপক্ষ ১৮০ দিনের মধ্যে বিভাগীয় কার্যক্রম শেষ না হওয়ার পুরোনো অজুহাত দেখিয়েছেন, যা ১০ বছর আগের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এছাড়া, ২৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বন্ধের সিদ্ধান্তও বিধি সম্মত হয়নি বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
২০২০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো নিয়মিত কমিটি নেই। অ্যাডহক কমিটি তার এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ করে আর্থিক অনিয়ম করেছে। ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডি প্রবিধানমালা ২০২৪-এর ৬৫ ধারার উপধারা-৩ লঙ্ঘন করে নামমাত্র মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ১০ জনকে সরিয়ে পছন্দের শিক্ষকদের শিফট ইনচার্জ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে এই পদে নিয়োগ পাওয়ার কথা।
অনুমোদনহীন ৮ শিফট: প্রতিষ্ঠানটির ৬টি ক্যাম্পাসের ১২টি শিফটের মধ্যে ৮টি শিফটেরই কোনো প্রকার অনুমোদন নেই। এই অনুমোদনহীন শিফটগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলছে।
সভাপতির বক্তব্য: মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাহমিনা আক্তার জানিয়েছেন, তিনি ৫ মাস আগে দায়িত্ব নিয়ে সব ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ রেখেছেন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি ও শিক্ষা বোর্ডকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) উপপরিচালক মো. ওয়াজকুরনী জানান, মনিপুর স্কুল সম্পর্কে একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয় এবং যে রিপোর্ট পাওয়া গেছে, তা আরও ভয়াবহ। তিনি আরও বলেন, গত ১৫ বছর ধরে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে হরিলুট করা হয়েছে। এজন্য ডিআইএ নতুন করে পূর্ণোদ্যমে তদন্ত শুরু করেছে।



