ইসলাম ধর্মবিশ্লেষণ

কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সহবস্থান: ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা

শালীনতা ও শরীয়তের সীমারেখা মেনে চললে মিশ্র পরিবেশে নারীর চাকরি হালাল

ধর্মীয় ডেস্ক: মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তর—ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক—এর জন্য ইসলাম এক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান দিয়েছে। বর্তমান যুগে নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন, প্রযুক্তি ও সমাজসেবার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এই প্রেক্ষাপটে কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ইসলামী বৈধতা ও উপার্জিত বেতনের হালাল-হারামের বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া জরুরি।

ইসলাম নারীদের জ্ঞান অর্জন, দক্ষতা ও সমাজে অবদান রাখার পথে কখনো বাধা দেয়নি; বরং উৎসাহিত করেছে। তবে শর্ত হলো, কর্মক্ষেত্রে অবশ্যই নারীকে তাঁর পর্দা, সম্মান ও চরিত্র রক্ষা করে চলতে হবে, যাতে কোনো ধরনের অশ্লীলতা বা ফিতনার সৃষ্টি না হয়।

ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে, যদি কোনো নারী একান্ত ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রয়োজনের কারণে পুরুষ সহকর্মীরাও যেখানে উপস্থিত, এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে বাধ্য হন, এবং তিনি যদি ইসলামী সীমারেখা কঠোরভাবে মেনে চলেন, তবে সেই কাজ তার জন্য বৈধ হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা কোরআনে ঘোষণা করেছেন: “আল্লাহ কারো উপর তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব চাপান না।” (সূরা আল-বাকারা: ২৮৬)। এই আয়াত অনুযায়ী, চরম প্রয়োজনে শরীয়তের শর্তগুলো পূরণ সাপেক্ষে কাজ করার অনুমতি রয়েছে।

নারী-পুরুষ সহবস্থান করে এমন পরিবেশে কাজ করার ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ত নারীকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা মেনে চলার কঠোর নির্দেশ দিয়েছে:

১. শালীন পোশাক ও পর্দা নিশ্চিতকরণ: কর্মস্থলে নারীর পরিধেয় পোশাক অবশ্যই শালীন, ঢিলেঢালা এবং অনাড়ম্বর হতে হবে। সৌন্দর্য প্রদর্শন বা অলংকার দেখানোর উদ্দেশ্যে পোশাক পরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

২. সংযত ও ভদ্র আচরণ: কাজের প্রয়োজনে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে অবশ্যই সংযম ও ভদ্রতা বজায় রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা কোরআনে সতর্ক করে বলেন: “তোমরা কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, যাতে যার অন্তরে রোগ আছে সে লালসায় না পড়ে।” (সূরা আল-আহযাব: ৩২)।

৩. ‘খলওয়াত’ বা নির্জনতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ: পরপুরুষের সঙ্গে কর্মস্থলের কোনো নির্জন স্থানে বা একান্তে অবস্থান করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যখন কোনো পুরুষ ও নারী একান্তে থাকে, তখন শয়তান তৃতীয়জন হয়।” (তিরমিজি)।

৪. অপ্রয়োজনীয় আলাপ ও হাসি-ঠাট্টা পরিহার: কর্মক্ষেত্রে কাজের বাইরে অপ্রয়োজনীয় হাসি-ঠাট্টা, দুষ্টামি, ফাজলামি বা অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে হবে।

৫. সুগন্ধি ও সাজসজ্জা বর্জন: কোনো ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার বা এমন সাজসজ্জা করা, যা পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা কর্মস্থলের জন্য পরিত্যাজ্য।

৬. দ্রুত বাড়ি ফেরা: কর্মস্থলে কাজের শেষে অপ্রয়োজনে বাইরে অবস্থান না করে দ্রুত নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়া উত্তম।

উপার্জনের হালাল-হারামের মানদণ্ড

যদি কোনো নারী উপরোক্ত ইসলামী শর্তাবলি যথাযথভাবে অনুসরণ করে কর্মজীবনে নিয়োজিত থাকেন, তবে তাঁর চাকরিকে জায়েজ বা বৈধ বলে গণ্য করা হবে এবং প্রাপ্ত বেতন বা মজুরি সম্পূর্ণ হালাল হবে। হালাল উপার্জিত অর্থ দিয়ে পরিবার পরিচালনা করা, সন্তানের শিক্ষা নিশ্চিত করা বা সমাজসেবা করা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত নেক কাজ।

ইসলাম নারীদের ঘরে আবদ্ধ রাখার কোনো বিধান দেয়নি; বরং সমাজে তাদের সম্মানজনক দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিয়েছে। রাসুল (সা.)-এর যুগেও নারীরা সমাজে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। উম্মে সালামা (রা.) গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, উম্মে আতিয়া (রা.) যুদ্ধক্ষেত্রে সেবিকার দায়িত্ব পালন করতেন এবং শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.) শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করেছেন।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলিম নারীদের এমন পেশা বা কর্মস্থল বেছে নেওয়া উচিত, যেখানে শালীনতা ও পর্দা রক্ষা করা তুলনামূলকভাবে সহজ। যেমন: শুধুমাত্র নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মহিলা হাসপাতাল, নারী ব্যাংক, অনলাইনে শিক্ষা প্রদান কিংবা ইসলামী সমাজসেবামূলক সংগঠন। একইসঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব হলো এমন একটি নিরাপদ ও নৈতিক কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে নারীরা সর্বোচ্চ মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে কাজ করতে পারেন।

সার্বিক বিচারে বলা যায়, ইসলাম নারীর উন্নয়ন বা কর্মজীবনের পথে কোনো বাধা নয়; এটি নারীর প্রকৃত মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। যে নারী নিজের ঈমান, শালীনতা ও আত্মসম্মান রক্ষা করে জীবিকা অর্জন করেন, তিনি কেবল নিজের নয়, বরং গোটা সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে আনেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button