ছোট লবঙ্গের মহাগুণ: ২২টি স্বাস্থ্য উপকারিতা
দাঁতের ব্যথা থেকে ক্যান্সার প্রতিরোধ পর্যন্ত বহু রোগের মহৌষধ মসলাপাতা ‘লং’
অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: ইউজেনল (Eugenol) নামক শক্তিশালী যৌগের কারণে লবঙ্গ বা লং (Clove), যার বোটানিক্যাল নাম Syzygiumaromaticum, শুধুমাত্র সুগন্ধি মসলা হিসেবে নয়, বরং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ হিসেবে পরিচিত। শুকনো ফুলের কুঁড়ি থেকে তৈরি এই লবঙ্গ যুগ যুগ ধরে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর প্রধান উপাদান ইউজেনল-এর রয়েছে শক্তিশালী জীবাণুনাশক এবং বেদনানাশক গুণাবলি।
লবঙ্গ তেলে ইউজেনল থাকে প্রায় ৭২-৯০%। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের মধ্যে রয়েছে অ্যাসিটাইল ইউজেনল, বেটা-ক্যারোফাইলিন, ভ্যানিলিন, ট্যানিন, ফ্ল্যাভানয়েড, এবং একাধিক ট্রাই-টারপেনয়েড যৌগ।
ইউএসএফডিএ (USFDA) এর তথ্য অনুসারে, ১০০ গ্রাম লবঙ্গে ৬৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৬ গ্রাম প্রোটিন, ১৩ গ্রাম ফ্যাট, ২৭৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি এবং ৩৩ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার থাকে। এটি ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাসিয়াম এবং জিঙ্ক সহ বি-৬, বি-১২, সি, এ, ই, ডি, কে সহ একাধিক ভিটামিনের একটি সমৃদ্ধ উৎস। এই সমস্ত যৌগের রয়েছে উল্লেখযোগ্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য।
প্রতিদিন সকালে ও রাতে মাত্র ২ থেকে ৩টি লবঙ্গ চিবিয়ে বা চুষে খেলে নিম্নের উপকারিতাগুলো পাওয়া যায়:
১. দাঁতের ব্যথা ও মাড়ির ক্ষয় নিরাময়: লবঙ্গের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান দ্রুত দাঁতের ব্যথা কমায় এবং মাড়ির ক্ষয় নিরাময়ে সাহায্য করে। টুথপেস্টের এটি একটি অন্যতম সাধারণ উপাদান।
২. বমি ভাব দূরীকরণ: লবঙ্গের রস চুষলে ট্রেনে বা বাসের মাথা ঘোরা বা বমি বমি ভাব দূর হয়। গর্ভবতী মায়েরা সকালের বমি ভাব দূর করতে লবঙ্গ চুষতে পারেন।
৩. সর্দি-কাশি ও ঠাণ্ডা উপশম: এটি সর্দিকাশির মহৌষধ। লবঙ্গ মুখে রেখে চুষলে সর্দি, কফ, ঠাণ্ডা লাগা, অ্যাজমা, গলা ফোলা এবং শ্বাসকষ্টে সুফল পাওয়া যায়।
৪. সাইনাস ইনফেকশন হ্রাস: সাইনোসাইটিসের চিকিৎসায় লবঙ্গ ব্যবহৃত হয়। এর ‘ইগুয়েনাল’ উপাদান সাইনাসের কষ্ট কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
৫. মাথা ব্যথা উপশম: ধোঁয়া, রোদ বা ঠাণ্ডাজনিত কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রকার মাথা ব্যথা কমাতে লবঙ্গ অত্যন্ত উপকারী।
৬. হজম ও পেটের রোগ উপশম: লবঙ্গ এনজাইম বৃদ্ধি করে বদহজম, ক্ষুধামান্দ্য (খিদে না হওয়া), পেটের গ্যাস, পেট ব্যথা, অজীর্ণ, কলেরা এবং আন্ত্রিক রোগের উপকার করে। এটি ফ্লাটুলেন্স ও ডিসপেপসিয়া কমায়।
৭. যৌন স্বাস্থ্য ও কামোদ্দীপক: লবঙ্গ কামোদ্দীপক হিসেবে কাজ করে, অবসাদ দূর করে মনকে সতেজ করে এবং যৌন শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
৮. মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠা হ্রাস: এক টুকরো লবঙ্গ চুষে খেলে বা লবঙ্গের চা পান করলে মেজাজ ফুরফুরে হয়ে ওঠে এবং স্ট্রেস ও উৎকণ্ঠা কমে।
৯. ব্রণের চিকিৎসায় ব্যবহার: ব্রণের চিকিৎসায় লবঙ্গ ব্যবহৃত হয়। এর পেস্ট ব্রণের ওপর ব্যবহার করলে দাগ দূর হয় এবং এটি খেলে ব্রণ হওয়া কমে যায়।
১০. রক্ত পরিশোধক: এটি শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিক উপাদান সরিয়ে রক্তকে পরিশোধন করতে সাহায্য করে।
১১. পিপাসা রোগ নিরাময়: যারা ঘন ঘন পিপাসায় আক্রান্ত হন, তারা সকালে ও বিকালে লবঙ্গ খেলে পিপাসা চলে যায়।
১২. খাবারে রুচি বৃদ্ধি: পেটের রোগ বা জ্বরের পর খাবারে অরুচি দেখা দিলে সকালে খালি পেটে এবং দুপুরে খাবারের পর লবঙ্গ চূর্ণ খেলে রুচি ফিরে আসে।
১৩. হজম ক্ষমতা সক্রিয়করণ: হজমে সহায়ক এনজাইম ও অ্যাসিড ক্ষরণের মাধ্যমে লবঙ্গ হজম ক্ষমতা সক্রিয় করে তোলে। এটি শরীরের রক্ত প্রবাহেরও উন্নতি ঘটায়।
১৪. বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদানের প্রাচুর্য: এতে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-কারসিনোজেনিক, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটোরি এবং হেপাটো-প্রোটেক্টিভসহ বহু বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান রয়েছে। এটি কলেরা, যকৃতের সমস্যা ও ক্যান্সার থেকে শরীরকে রক্ষা করে।
১৫. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা: গবেষণায় দেখা গেছে, লবঙ্গের রস শরীরের ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করে এবং এর কর্মক্ষমতা বাড়ায়, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
১৬. মুখের রোগ ও দুর্গন্ধ দূরীকরণ: জিনজিভাইটিস ও পেরিওডনটাইটিসের মতো মাড়ির সমস্যায় লবঙ্গ খুব উপকারী। এর মুকুল ওরাল প্যাথোজেনের বৃদ্ধি রোধ করে। মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে রাতে ২-৩টি লবঙ্গ চিবিয়ে বা চুষে ঘুমালে নিঃশ্বাস সতেজ থাকে।
১৭. আর্থ্রাইটিসের যন্ত্রণা হ্রাস: লবঙ্গের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান আর্থ্রাইটিসের প্রকোপ, জয়েন্ট পেইন, পেশির ব্যথা, হাঁটু, পিঠ বা হাড়ের ব্যথা এবং ফোলা ভাব কমাতে সাহায্য করে।
১৮. জ্বরের প্রকোপ কমানো: লবঙ্গে থাকা ভিটামিন কে এবং ই রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে ভাইরাসকে ধ্বংস করে, ফলে ভাইরাল ফিবারের প্রকোপ দ্রুত কমে।
১৯. ত্বকের সংক্রমণ সারাতে: এর ভোলাটাইল অয়েল টক্সিক উপাদান ও জীবাণুকে শরীর থেকে বের করে দেয়, ফলে সংক্রমণজনিত কষ্ট কমতে সময় লাগে না। এটি ঘা-পাঁচড়াও হতে দেয় না।
২০. লিভারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি: লবঙ্গের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লিভারসহ শরীরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কর্মক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এতে হেপাটো-প্রোটেক্টিভ প্রপার্টিজ রয়েছে।
২১. শরীর ফোলা কমানো: ঠাণ্ডাজনিত কারণে শরীরের কোনো অংশ ফুলে গেলে লবঙ্গ খেলে তা কমে যায়।
২২. হাড়ের দৃঢ়তা বৃদ্ধি: লবঙ্গে উপস্থিত ফেনোলিক কম্পাউন্ড যেমন ইউজেনল, হাড়ের ঘনত্ব (Bone Density) উন্নত করে এবং হাড়ের ভেতরের খনিজের ঘাটতি পূরণ করে, যা বয়স্ক ও নারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২৩. ক্যান্সার প্রতিরোধ: লবঙ্গ ব্রেস্ট ক্যান্সার ও ওভারিয়ান ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।



