ইসলাম ধর্ম

জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত মহীয়সী নারী সাহাবীরা: তাঁদের আত্মত্যাগ ও অনন্য মর্যাদা

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: মুসলিম সমাজে পুরুষ সাহাবীদের জান্নাতের সুসংবাদের কথা বহুল পরিচিত হলেও, বেশ কিছু নারী সাহাবীও রয়েছেন যাদেরকে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সরাসরি জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তাঁদের ঈমান, ধৈর্য, ইবাদত এবং ইসলামের প্রতি অসামান্য অবদানের কারণে তাঁরা এই বিরল সম্মান লাভ করেছেন। নিচে এমনই কয়েকজন মহীয়সী নারীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও তাঁদের জান্নাত লাভের সুসংবাদ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.):
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রথম সহধর্মিণী খাদিজা (রা.) ইসলামের প্রথম সমর্থক ও এক সাহসী চরিত্রের অধিকারিণী ছিলেন। প্রতিকূল সময়ে তিনি রাসূল (সা.)-কে অকুন্ঠ সমর্থন ও সাহস যুগিয়েছেন।
নবী (সা.) বলেন: «اقرأ عليها السلام من ربها عز وجل ومني وبشرها ببيت في الجنة لا صخب فيه ولا نصب» “আপনি খাদিজাকে তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এবং আমার পক্ষ থেকে সালাম জানিয়ে দিন এবং তাঁকে জান্নাতে এমন এক গৃহের সুসংবাদ দিন, যেখানে থাকবে না কোনো শব্দের কোলাহল, থাকবে না কোনো কষ্ট।” (সহীহ বুখারী: ৩৮২০, সহীহ মুসলিম: ২৪৩২)।

২. ফাতিমা (রা.):
রাসূল (সা.)-এর প্রিয় কন্যা ফাতিমা (রা.) ছিলেন ধৈর্য, ইবাদত ও আনুগত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর এই গুণাবলী তাঁকে জান্নাতের নারীদের নেত্রী হওয়ার মর্যাদা দিয়েছে।
নবী (সা.) ঘোষণা করেন: «فاطمة سيدة نساء أهل الجنة» “ফাতিমা হলো জান্নাতের নারীদের নেত্রী।” (সহীহ তিরমিযী: ৩৮০৫)।

৩. উম্মু সুলাইম (রা.):
আনাস ইবন মালিক (রা.)-এর মা উম্মু সুলাইম (রা.) ইসলামের জন্য এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন। মক্কায় হিজরতের সময় তিনি নিজের সন্তান আনাসকে নবী (সা.)-এর সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন।
রাসূল (সা.) বলেছেন: «دخلت الجنة فسمعت خشفةً فقلت: من هذا؟ قالوا: هذه العمیصاء بنت ملحان أم أنس بن مالك» “আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম, হঠাৎ কারো পদধ্বনি শুনতে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এটি কার? বলা হলো, উম্মু সুলাইম।” (সহীহ বুখারী: ৩৭৫০, সহীহ মুসলিম: ২৪২০)।

৪. উম্মু জাফর (রা.):
তিনি মৃগীরোগে আক্রান্ত ছিলেন, কিন্তু চরম ধৈর্যের সাথে তিনি এই অসুস্থতা মোকাবিলা করেছেন। তাঁর এই ধৈর্য ধারণের পুরস্কার হিসেবে তিনি জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করেন।
নবী (সা.) তাঁকে বলেন: «أتصبرين ولك الجنة» “তুমি যদি ধৈর্য ধারণ করো তবে তোমার জন্য জান্নাত।” (সহীহ বুখারী: ৫৬৮৩, সহীহ মুসলিম: ২৪০০)।

৫. উম্মু হারাম বিনতে মিলহান (রা.):
আনাস ইবন মালিক (রা.)-এর খালা উম্মু হারাম (রা.) মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন।
রাসূল (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন: «أول جيش من أمتي يغزون البحر قد أوجبوا» “আমার উম্মতের প্রথম বাহিনী যারা সমুদ্রপথে যুদ্ধ করবে, তাদের জন্য জান্নাত অবধারিত।” তিনি (উম্মু হারাম) প্রশ্ন করেন: আমি কি তাদের মধ্যে থাকব? নবী (সা.) উত্তর দিলেন: “হ্যাঁ, তুমি তাদের মধ্যে থাকবে।” (সহীহ বুখারী: ২৯০৭)।

৬. নুসাইবা বিনতে কা’ব (উম্মু উমারা, রা.):
উহুদ যুদ্ধে নুসাইবা (রা.) তাঁর অসামান্য সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর আত্মত্যাগ ও সাহসিকতা দেখে নবী (সা.) মুগ্ধ হয়েছিলেন।
তিনি দু’আ করেন: «اللهم اجعلهم رفقائي في الجنة» “হে আল্লাহ! তাঁদের জান্নাতে আমার সঙ্গী বানিয়ে দাও।” (সহীহ মুসলিম: ১৭৩০)।

৭. রুবাইয়্যি বিনতে মু’আজ (রা.):
তিনি হুদায়বিয়ার সময় ‘শাজারা বায়আত’ বা গাছের নিচে সংঘটিত বায়আতে অংশ নিয়েছিলেন, যা ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
রাসূল (সা.) ঘোষণা করেন: «لا يدخل النار أحد ممن بايع تحت الشجرة» “যারা গাছের নিচে বায়আত করেছে, তাদের কেউই জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।” (সহীহ বুখারী: ৩১৯৭, সহীহ মুসলিম: ১৮২০)।

৮. সুমাইয়া বিনতে খায়্যাত (রা.):
ইসলামের প্রথম শহীদা সুমাইয়া (রা.) ছিলেন ইয়াসির (রা.)-এর স্ত্রী। ইসলামের পথে অটল থাকার কারণে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
নবী (সা.) তাঁদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন: «صبرا آل ياسر فإن موعدكم الجنة» “ধৈর্য ধারণ করো হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের জন্য জান্নাত নির্ধারিত।” (সহীহ বুখারী: ২৯৪১, সহীহ মুসলিম: ১৮১২)।

৯. আয়িশা (রা.):
রাসূল (সা.)-এর স্ত্রী আয়িশা (রা.) ছিলেন ইসলামি জ্ঞানের এক প্রবাদপ্রতিম নারী। তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তাঁকে এক বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।
রাসূল (সা.) স্বপ্নে তাঁকে দেখে বলেছিলেন: «هذه زوجتك في الدنيا والآخرة» “এটাই আপনার স্ত্রী, দুনিয়া ও আখিরাতে।” (সহীহ বুখারী: ৩৮৯০, সহীহ মুসলিম: ২৩২০)।

১০. উম্মু রুমান (রা.):
আবু বকর (রা.)-এর স্ত্রী এবং আয়িশা (রা.)-এর মা উম্মু রুমান (রা.)-এর বিশেষ মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন: «من أحب أن ينظر إلى امرأة من الحور العين فلينظر إلى أم رومان» “যে ব্যক্তি জান্নাতের হুরে-আইনদের একজনকে দেখতে চায়, সে যেন উম্মু রুমানের দিকে তাকায়।” (সহীহ তিরমিযী: ৩৮৯৮)।

১১. ফাতিমা বিনতে আসাদ (রা.):
আলী ইবন আবি তালিব (রা.)-এর মা ফাতিমা বিনতে আসাদ (রা.) প্রথম দিককার মুহাজির মহিলাদের মধ্যে অন্যতম।
তাঁর সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন: «إن جبريل أخبرني عن ربي عز وجل أنها من أهل الجنة» “জিবরাইল আমাকে জানিয়েছেন, তিনি জান্নাতের অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত।” (সহীহ বুখারী: ৩৭৫৫, সহীহ মুসলিম: ২৪১০)।

১২. হাফসা বিনতে উমর (রা.):
উমর ইবন খাত্তাব (রা.)-এর কন্যা এবং নবী (সা.)-এর স্ত্রী হাফসা (রা.) ছিলেন সিয়াম ও কিয়াম পালনকারী এক ইবাদতগুজার নারী।
রাসূল (সা.) তাঁকে তালাক দিতে চাইলে জিবরাইল (আ.) তাঁকে বলেন: «إنها صوامة قوامة، وإنها زوجتك في الجنة» “তাঁকে তালাক দেবেন না, তিনি সিয়াম ও কিয়ামের অভ্যাসকারী এবং জান্নাতে আপনার স্ত্রী।” (সহীহ বুখারী: ৩৮১০, সহীহ মুসলিম: ২৪২৫)।

চারজন শ্রেষ্ঠ নারী:
রাসূল (সা.) বিশেষভাবে চারজন মহীয়সী নারীর শ্রেষ্ঠত্ব উল্লেখ করেছেন:

  • খাদিজা (রা.)
  • ফাতিমা (রা.)
  • আসিয়া বিনতে মুজাহিম (ফিরআউনের স্ত্রী)
  • মরিয়ম বিনতে ইমরান

এই মহীয়সী নারীরা তাঁদের ঈমান, আত্মত্যাগ এবং ইসলামের প্রতি অবিচল নিষ্ঠার কারণে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত হয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁদের সঙ্গী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button