অপরাধদেশপ্রতারনাবাংলাদেশসম্পাদকীয়

অনলাইন অ্যাপের ফাঁদ: চীনা পাত্রদের হাতে বাংলাদেশি নারীরা পাচারের শিকার, সতর্ক করেছে চীনা দূতাবাসও

বিশেষ প্রতিবেদন: সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে—মাত্র এক মাসের পরিচয়ে, অ্যাপসের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করে একজন চীনা যুবকের সঙ্গে সুরমা নামের এক বাংলাদেশি তরুণীর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। দু’জনের কেউই কারো ভাষা জানেন না, ইংরেজিও নয়, ভরসা কেবল ভয়েস ট্রান্সলেটর। এই ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটল, যখন গত ২৫ মে ঢাকার চীনা দূতাবাস নিজেরাই তাদের নাগরিকদের এই ধরনের বিয়েতে জড়াতে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছে।

দূতাবাসের সতর্কতা ছিল মূলত দেশের ‘নিঃসঙ্গ পুরুষদের’ উদ্দেশ্য করে—যাতে তারা বিদেশি স্ত্রী কেনা, অনলাইন ডেটিং, ‘সোলম্যাট’ সাইট স্ক্যাম বা এজেন্টের ফাঁদে না পড়েন। যদিও এটি চীনের পুরুষদের শিকার হওয়ার কথা বললেও, বহু আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে, চীনা পাত্রদের হাতে বাংলাদেশি ও দক্ষিণ এশিয়ার নারীরাই বেশি পাচারের শিকার হন।

এসব ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর পরিচয় পর্ব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। উল্লেখিত ঘটনার পাত্র-পাত্রীর পরিচয় মাত্র দুই সপ্তাহের। কিন্তু এত অল্প সময়েই তারা বিয়ের মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চীনা পাত্ররা সাধারণত মেয়েদের দুর্বলতাকে কাজে লাগায়। এক মেয়ের ভাষ্যমতে, তার বয়ফ্রেন্ড তাকে অন্য একজন গরিব ঘরের মেয়ে খুঁজে দিতে বলেছিল, যার বিনিময়ে বয়স্ক বন্ধু টাকা দেবে—যা সরাসরি নারী পাচারের ইঙ্গিত দেয়। এত বড় প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অনেক মেয়েই এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন।

গত কয়েক মাস ধরে দেখা যাচ্ছে, চীনা ছেলেরা বিশেষত বেনামী অ্যাপসের (যেমন: টিকটক-এর মতো অ্যাপস, যার উল্লেখ মূল লেখায় করা হয়েছে কিন্তু নামগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে) মাধ্যমে বাংলাদেশের দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। এরপর তারা বাংলাদেশে এসে মেয়েদের ধর্ম, যেমন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বা তাতে রাজি হয়ে মেয়েদের সহজেই প্রভাবিত করে।

নিউজসূত্রের অনুসন্ধান অনুযায়ী, এভাবে বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া মেয়েদের চীনে নিয়ে গিয়ে মূলত দুটি ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়:

  1. বিক্রি করে দেওয়া: এদেরকে চীনের গ্রামীণ এলাকায় বয়স্ক পুরুষদের স্ত্রী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
  2. জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি: অনেককে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়।

এক সন্তান নীতির কারণে চীনের গ্রামীণ অঞ্চলে নারীদের প্রচণ্ড সংকট চলছে। আর এই সংকট মেটাতেই বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত ও পাকিস্তানের দরিদ্র, লোভী বা সহজ সরল মেয়েদের টার্গেট করা হচ্ছে।

এক ভুক্তভোগী মেয়ে নিজের বিয়েতে প্রতারিত হওয়ার পর নিজের খালাতো বোনকেও বিয়ে দিয়ে চীনে নিয়ে যান। পরে তারা বুঝতে পারেন, তারা ফাঁদে পড়েছেন এবং জোর করে পতিতাবৃত্তি করানো হচ্ছে। যদিও তিনি পালিয়ে আসতে পেরেছেন, তার খালাতো বোন এখনও সেখানে বন্দি।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু পাকিস্তানেই ২ বছরে ৬০০-এরও বেশি মেয়েকে বিয়ের নামে পাচার করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে সে দেশের সরকার নড়েচড়ে বসে। এই পাচারে বেশিরভাগ দরিদ্র খ্রিস্টান ধর্মের মেয়েদের টার্গেট করা হয়েছিল। বাংলাদেশে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলেও সরকারের টনক কবে নড়বে, তা দেখার বিষয়।

সতর্ক বার্তা: অনলাইন প্রেম এবং স্বল্প পরিচয়ের ভিত্তিতে চীনা নাগরিকদের বিয়ের ফাঁদে পা দেওয়া থেকে দেশের প্রতিটি মেয়েকে কঠোরভাবে বিরত থাকতে পুনরায় সতর্ক করা হলো। জনমনে দাবি উঠেছে: “সেভ আওয়ার বাংলাদেশি সিস্টার্স ফ্রম চাইনিজ মেন” শিরোনামে একটি সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো জরুরি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button