ইসলাম ধর্ম

সুরা ফাতিহা: আধ্যাত্মিক যাত্রাপথ ও প্রত্যাবর্তনের সাত সোপান

এরশাদুল হক নূরী: নফস থেকে রূহের দিকে প্রত্যাবর্তনের মানচিত্র হলো ফাতিহা

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: নূরী শাহ পাক দরবার শরীফের পীর সাহেব এরশাদুল হক নূরী সূরা ফাতিহার বাতেনী (ভেতরের) তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন, সমগ্র কুরআনের মর্মবস্তু এই সূরায় নিহিত। বাহ্যিক অর্থে এটি আল্লাহ্‌র প্রশংসা হলেও, এর ভেতরের ব্যাখ্যাটি হলো ‘আত্মার যাত্রাপথ’—যা সৃষ্টি থেকে স্রষ্টার দিকে প্রত্যাবর্তন করার এক নিখুঁত মানচিত্র।


ফাতিহার বাতেনী তাফসির: স্তরভিত্তিক ব্যাখ্যা

১. بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম)

  • সাধারণ অর্থ: পরম করুণাময়, অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
  • বাতেনী ব্যাখ্যা: এই আয়াতটি হলো ‘আত্মার দ্বার উন্মোচনের চাবিকাঠি’। এর উচ্চারণ প্রতিটি কাজ ও চিন্তার সূচনাকে আল্লাহ্‌র উপস্থিতি স্মরণে নিবদ্ধ করার প্রতীক। ‘বি-সম’ (নামের মাধ্যমে) বলতে নিজস্ব অস্তিত্বকে আল্লাহ্‌র নামের জ্যোতিতে বিলীন করে দেওয়াকে বোঝায়। ‘রাহমান’ হলো বিশ্বজগতের প্রতি প্রসারিত আল্লাহ্‌র সর্বজনীন দয়া, আর ‘রাহিম’ হলো সেই রহস্যময় প্রেম, যা বান্দার অন্তরে গোপনে প্রবাহিত হয় এবং আত্মা যখন প্রেমে গলে যায়, তখন এই ‘রহিমিয়্যাত’ প্রকাশ পায়।
  • আধ্যাত্মিক শিক্ষা: যে আত্মা বিসমিল্লাহ জপতে জপতে আত্মবিস্মৃত হয়, সে আল্লাহ্‌র প্রেমে মিশে যায়।

২. اَلْـحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِينَ (আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন)

  • সাধারণ অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সকল জগতের পালনকর্তা।
  • বাতেনী ব্যাখ্যা: ‘আলহামদু’ কেবল বাচনিক প্রশংসা নয়; এটি হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উত্থিত গভীর কৃতজ্ঞতার প্রতীক। আত্ম-পরিচয় লাভকারী ব্যক্তি উপলব্ধি করে যে, তার দেহ, মন, চেতনা ও জ্ঞান—সমস্ত কিছুই ‘রাব্বুল আলামীন’ কর্তৃক লালিত হচ্ছে। ‘রাব্ব’ বলতে বোঝায় যিনি কোনো কিছুকে ক্রমান্বয়ে পরিপূর্ণতার পথে চালিত করেন। ফলস্বরূপ, ‘রাব্বুল আলামীন’ হলো সেই সত্তা যিনি মানুষের অন্তর্গত জগতের প্রতিটি অংশকে জ্যোতির্ময় করে তোলেন।
  • আধ্যাত্মিক শিক্ষা: যে প্রতিটি নিশ্বাসে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ অনুভব করে, তার প্রবৃত্তি (নফস) শান্ত হয় এবং রূহ (আত্মা) জেগে ওঠে।

৩. الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (আররাহমানির রাহিম)

  • সাধারণ অর্থ: যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
  • বাতেনী ব্যাখ্যা: পূর্ববর্তী ব্যাখ্যার ধারাবাহিকতায় এই দুটি নাম নির্দেশ করে—আল্লাহ্‌র প্রেম সর্বজনীন (রহমান) এবং একইসাথে ব্যক্তিগত ও রহস্যময় (রহিম)। যে বান্দা ধ্যানের মাধ্যমে নিজের গভীরে প্রবেশ করে, সে হৃদয়ের কোমলতায় ‘রহিমিয়্যাতের প্রতিফলন’ অনুভব করতে পারে।
  • আধ্যাত্মিক শিক্ষা: ‘রহমান’ তোমাকে বিশ্বজগত দেখায়, আর ‘রহিম’ তোমাকে তোমার নিজের ভেতর দেখায়।

৪. مٰلِكِ يَوْمِ الدِّينِ (মালিকি ইয়াওমিদ্দিন)

  • সাধারণ অর্থ: প্রতিফল দিবসের মালিক।
  • বাতেনী ব্যাখ্যা: ‘ইয়াওমিদ্দিন’ শুধু কিয়ামতের দিন নয়, বরং প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে আত্মার যে আত্ম-পর্যালোচনা ঘটে, সেটিই ‘দীন দিবস’। যখন অন্তর পাপের পরে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়, তখনই ‘ইয়াওমিদ্দিন’ উপস্থিত হয়। ‘মালিক’ অর্থাৎ একক নিয়ন্তা আল্লাহ্‌—আমার নফস, রূহ, চেতনা—সবকিছুর উপর তাঁরই কর্তৃত্ব।
  • আধ্যাত্মিক শিক্ষা: যতক্ষণ তুমি মনে করবে ‘আমি কিছু করার ক্ষমতা রাখি’, ততক্ষণ তুমি দীন দিবসের পরীক্ষায় অকৃতকার্য। যখন বলবে ‘সবই তাঁর ইচ্ছায় হচ্ছে’, তখনই মুক্তি।

৫. إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ (ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তা’ইন)

  • সাধারণ অর্থ: আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
  • বাতেনী ব্যাখ্যা: এটি আত্মসমর্পণের মূলমন্ত্র। ‘নাবুদু’ অর্থাৎ আমি আমার অস্তিত্বকে তোমার দাসত্বে বিলীন করে দিচ্ছি। ‘নাস্তা’ইন’ অর্থাৎ আমি আমার নিজস্ব শক্তির ওপর নির্ভরশীল নই—আমি তোমার শক্তিই চাই। যে অন্তর নির্দ্বিধায় ঘোষণা করে ‘শুধু তুমিই’, সেই তাওহিদের (একত্ববাদ) মূল প্রবেশদ্বারে প্রবেশ করে।
  • আধ্যাত্মিক শিক্ষা: আসল ইবাদত শুধুমাত্র বাহ্যিক নামাজ বা রোজা নয়—বরং নিজের প্রবৃত্তিকে (নফস) ভেঙে আল্লাহ্‌র প্রেমে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করা।

৬. اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ (ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম)

  • সাধারণ অর্থ: আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।
  • বাতেনী ব্যাখ্যা: ‘সিরাতাল মুস্তাকীম’ কোনো বাহ্যিক পথ নয়; এটি হলো আত্মার ভেতরের যাত্রাপথ—প্রবৃত্তির অন্ধকার থেকে রূহের আলোর দিকে। এই পথে তাওহিদ, প্রেম, সত্য এবং প্রকৃত আত্ম-পরিচয় অর্জনের দিশা রয়েছে।
  • আধ্যাত্মিক শিক্ষা: যখন তুমি নিজের অহংকে চূর্ণ করে আল্লাহ্‌র জ্যোতিতে পথ চলবে, তখনই তুমি ‘সিরাতাল মুস্তাকীম’-এ স্থিত হতে পারবে।

৭. صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ (সিরাতাল্লাযীনা আনআমতা আলাইহিম, গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ্দল্লিন)

  • সাধারণ অর্থ: যাদের উপর তুমি অনুগ্রহ করেছ, তাদের পথ; না তাদের পথ, যাদের প্রতি তোমার রোষ নাযিল হয়েছে, না তাদের, যারা পথভ্রষ্ট।
  • বাতেনী ব্যাখ্যা: ‘আনআমতা আলাইহিম’ বলতে সেই সব মানবাত্মাকে বোঝানো হয়েছে, যাদের অন্তর আল্লাহ্‌র প্রেমে আলোকিত। এরা হলেন আরিফ, মুর্শিদ, বা অলিয়া—যারা নিজেকে চিনে প্রভুকে চিনতে পেরেছেন। ‘মাগদুব’ হলো তারা, যারা জ্ঞান লাভ করেও অহংকারের কারণে তা হারিয়েছে। আর ‘দাল্লিন’ হলো তারা, যারা দুনিয়ার মায়ার পথে বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
  • আধ্যাত্মিক শিক্ষা: যে আত্মা আল্লাহ্‌র প্রেমে জাগ্রত হয়, সে-ই অনুগ্রহপ্রাপ্তদের কাতারে প্রবেশ করে।

সূরা ফাতিহা ‘মানুষের আল্লাহ্‌র দিকে প্রত্যাবর্তন যাত্রার সাতটি আধ্যাত্মিক সোপান’ হিসেবে চিহ্নিত। এই সূরা আত্মাকে প্রবৃত্তি (নফস) থেকে মুক্ত করে রূহের (আত্মা) রাজ্যে উড্ডীন হতে সাহায্য করে। যেহেতু এটি ভালোবাসার দরজা খুলে দেয়, যেখান দিয়ে মানুষ তার রবকে খুঁজে পায়, তাই প্রতিটি নামাজে এটি পাঠ করা হয়।

সূরা ফাতিহার মূল নির্যাস ও আবেদন

১. সঠিক পথের জন্য দোয়া: এই সূরার শেষ দুটি আয়াত—”ইয়েদিনা আস-সিরাতাল মুস্তাকিম” (আমাদেরকে সোজা পথে পরিচালিত করুন) এবং “সিরাতাল্লাজিনা আন’আমতা আ’লাইহিম গাইরিল মাগদুবি আ’লাইহিম ওয়ালাদ দ্বাল্লিন” (যারা আপনার অনুগ্রহপ্রাপ্ত, তাদের পথে, যারা পথভ্রষ্ট বা গোনাহগার, তাদের পথে নয়)—আল্লাহ্‌র কাছে সঠিক পথের জন্য বান্দার অবিরাম প্রার্থনাকে তুলে ধরে।

২. দোয়া ও তার জবাব: সূরা ফাতিহা হলো বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহ্‌র কাছে একটি আবেদন। এর প্রথম তিনটি আয়াত আল্লাহ্‌র প্রশংসা এবং গুণগানে মুখরিত, এবং শেষ দুটি আয়াতে বান্দা হেদায়েতের প্রার্থনা করে। এটি কুরআনের সাথে বান্দার সম্পর্ককে দোয়া ও তার জবাবের বন্ধনে দৃঢ় করে।

৩. ঐশীগ্রন্থের ভূমিকা: সূরা ফাতিহা একইসাথে কুরআনের সারমর্ম এবং ভূমিকা। এটি এমন এক ঐশীগ্রন্থের প্রবেশপথ, যা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেয় এবং স্রষ্টার সাথে বান্মবের সম্পর্ককে আরও নিবিড় করে।

এইভাবে, সূরা ফাতিহার উপসংহার হলো আল্লাহ্‌র প্রতি পূর্ণ আনুগত্য এবং উভয় জগতে সফলতার পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য বান্দার পক্ষ থেকে এক দৃঢ় অঙ্গীকার ও প্রার্থনা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button